ইমান-আকিদাইসলামকুরআননাবী ও রাসূলহাদিস

দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরহামুর রাহিমীন। তিনি জগদ্বাসীর জন্যে রহমাতুল্লিল আলামীন হিসাবে প্রেরণ করেছেন খাতামুন নাবিয়্যীন সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় অনুগ্রহ যেতিনি আমাদেরকে আখেরী নবীর উম্মত হিসাবে মনোনীত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ  وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.

বাস্তবিকপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যেতিনি তাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরই মধ্য থেকেযিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেনতাদেরকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। আর তারা তো এর পূর্বে ছিল স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪

পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্নভাবে। সূরা আহযাবে আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ . فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِیَ اللهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِیْمِ.

(হে লোকসকল!) তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকেই রাসূল আগমন করেছেনতোমাদের কষ্ট যার নিকট অসহনীয়যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য ব্যাকুলযিনি মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশপরম মমতাবান। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে (হে নবী) আপনি বলে দিনআমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তার উপরই আমি ভরসা করি এবং তিনি মহান আরশের মালিক। -সূরা তাওবা (৯) : ১২৮১২৯

 

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র ও স্নেহশীল ছিলেন। উম্মতের কল্যাণে তিনি সদা ব্যাকুল থাকতেন। উম্মত কীভাবে নাজাত ও মুক্তি লাভ করতে পারে এ ফিকিরে তিনি ছিলেন সদা বিভোর। সর্বোপরি এই উম্মতের উপর রয়েছে তাঁর অবারিত ইহসান-অনুগ্রহপার্থিব-অপার্থিব উভয় বিবেচনায়। তাই উম্মতের কর্তব্য হলনবীজীর সেই ইহসানের দাবি রক্ষা করা।

উম্মতের উপর নবীজীর যে সীমাহীন ইহসান রয়েছেএর অন্যতম দাবি হচ্ছে নবীজীর প্রতি দরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করা। এটা আমাদের উপর নবীজীর হক। নতুবা নবীজীর প্রতি দরূদ পেশ করার আমরা কে! যেখানে স্বয়ং আরহামুর রাহিমীন ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীজীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন সেখানে আমাদের মতো নগণ্য উম্মতের দরূদের কোনোই প্রয়োজন নেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। যেখানে খোদ রাব্বুল আলামীন স্বীয় হাবীবকে দান করেছেন মাকামে মাহমুদ-জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদাসেখানে তাঁর জরুরত নেই আমাদের কারো দরূদ ও সালামের।

কিন্তু তবুও কেন এই নির্দেশ- দরূদ ও সালাম পাঠ করতে হবে তাঁর প্রতিহাঁএতীম এ উম্মতীকে নিজের স্বার্থেই নিবেদন করতে হবে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম- ভক্তিশ্রদ্ধা ও ভালবাসার সবটুকু দিয়ে। নবীজীর প্রতি আমাদের মহব্বত এমন কিছুই দাবি করে।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ اللهَ وَ مَلٰٓىِٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَی النَّبِیِّ  یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَیْهِ وَ سَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.

নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি ‘সালাত’ প্রেরণ করেন। হে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা তার প্রতি ‘সালাত’ পৌঁছাও এবং অধিক পরিমাণে সালাম পেশ কর। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৬

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করাকেই আমরা দরূদ বলে অভিহিত করে থাকি। বস্তুত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় শান অনুযায়ী নিজ হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ বর্ষণ করেন। ফিরিশতাগণও আপন আপন পর্যায় থেকে দরূদ প্রেরণ করেন নবীজীর প্রতি। আর তাই উম্মতেরও কর্তব্য হচ্ছে স্বীয় অবস্থান থেকে মহান মুহসিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম নিবেদন করা।

আল্লাহ তাআলা নবীজীর উপর দরূদ বর্ষণ করেন- এর অর্থ কীএর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা নিজ হাবীবের উপর রহমত বর্ষণ করেন। তার গুণগান ও মর্যাদা বর্ণনা করেন ফিরিশতাদের নিকট। তিনি তাঁর বন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ববড়ত্ব ও মহত্ত্ব বয়ান করেন এবং তার সম্মান ও  মর্যাদা বৃদ্ধি করতে থাকেন।

আর ফিরিশতাগণ দরূদ প্রেরণ করেন- এর অর্থ হলফিরিশতাগণ আল্লাহ তাআলার নিকট নবীজীর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তলব করতে থাকেন। বরকতের দুআ করতে থাকেন নবীজী ও তাঁর পুত পবিত্র পরিবারের জন্য।

আর মুমিনগণ যে দরূদ পেশ করেন- এর অর্থ হলতারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো পদ্ধতিতে দরূদ পাঠ করতে থাকেন। মুমিনগণ আল্লাহ তাআলার নিকট দরখাস্ত করতে থাকেনইয়া রব! আপনি আপনার হাবীবের শান ও মান বৃদ্ধি করতে থাকুন। দুনিয়াতে তাঁর আলোচনা সমুন্নত করুন। তাঁর আনীত শরীয়তকে প্রতিষ্ঠিত করুন। তাঁর দ্বীনকে আপনি বুলন্দ করে দিন। আখেরাতে তাঁকে শ্রেষ্ঠ প্রতিদানে ভূষিত করুন। উম্মতের জন্য তার শাফাআত কবুল করুন। তাঁকে মাকামে মাহমূদ দান করে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করুন। এভাবে ঊর্ধ্বজগৎ ও ইহজগতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারীহাফেয ইবনে হাজার ১১/ ১৫৫১৫৬আলকওলুল বাদীহাফেয সাখাবীপৃ. ৫১-৫৭)

দরূদ শরীফের ফযীলত

মূলত আমাদেরকে দরূদ পড়তে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। আমাদের দরূদে নবীজীর কোনো প্রয়োজন নেই। যিনি দরূদ ও সালাম পেশ করবেন তার নিজেরই ফায়দা। দুনিয়া ও আখেরাতের নানাবিধ কল্যাণ সম্পৃক্ত রয়েছে দরূদের সাথে। কুরআনে কারীমের নির্দেশনাসহ হাদীস শরীফে দরূদের বহু ফযীলত বিবৃত হয়েছে। এখানে কিছু উল্লেখ করা হল।

দরূদ শরীফ : মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ

ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হলতোমরা নবীজীর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ কর। আল্লাহ বলেন-

اِنَّ اللهَ وَ مَلٰٓىِٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَی النَّبِیِّ  یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَیْهِ وَ سَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.

নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি ‘সালাত’ প্রেরণ করেন। হে যারা ঈমান এনেছ তোমরা তার প্রতি ‘সালাত’ পৌঁছাও এবং অধিক পরিমাণে সালাম পেশ কর। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৬

অতএব দরূদ পাঠের মাধ্যমে মহান রবের মহান নির্র্র্র্র্দেশ পালিত হয়। এছাড়া যেখানে খোদ রাব্বুল আলামীন স্বীয় হাবীবের প্রতি দরূদ প্রেরণ করছেনফিরিশতাগণও পেশ করছেন নবীজীর প্রতি দরূদঊর্ধ্বজগতে গুঞ্জরিত হচ্ছে নবীর শানে দরূদসেখানে আমিও এই ধরাধাম থেকে দয়ার নবীর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করার মাধ্যমে শামিল হচ্ছি সেই মুবারক কাফেলায়।

সাহাবায়ে কেরাম অধীর ছিলেন দরূদের জন্যে

ঈমানদারদের উপর যখন আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে নবীজীর প্রতি দরূদ পেশ করার নির্দেশ আসে তখন সাহাবায়ে কেরাম অস্থির হয়ে পড়েন- কীভাবে নবীজীর প্রতি দরূদ পেশ করা যায়। তারা এ বিষয়ে নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলে নবীজী তাদেরকে দরূদ শরীফ শিখিয়ে দেন। হযরত কা‘ব ইবনে উজরাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-

لَمَّا نَزَلَتْ اِنَّ اللهَ وَ مَلٰٓىِٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَی النَّبِیِّ قَالُوا: كَيْفَ نُصَلِّي عَلَيْكَ يَا نَبِيَّ اللهِ؟ قَالَ: قُولُوا اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.

যখন

اِنَّ اللهَ وَ مَلٰٓىِٕكَتَهٗ یُصَلُّوْنَ عَلَی النَّبِیِّ  یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَیْهِ وَ سَلِّمُوْا تَسْلِیْمًا.

(নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি ‘সালাত’ প্রেরণ করেন। হে যারা ঈমান এনেছ তোমরা তার প্রতি ‘সালাত’ পৌঁছাও এবং অধিক পরিমাণে সালাম পেশ কর।)

আয়াতটি নাযিল হয় তখন সাহাবীগণ বললেনইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! আমরা আপনার প্রতি কীভাবে দরূদ পাঠ করবনবীজী বললেনতোমরা বলো-

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.

(হে আল্লাহ! আপনি সালাত ও রহমত বর্ষণ করুন মুহাম্মাদের প্রতি এবং মুহাম্মাদের পরিবার পরিজনের প্রতি। যেভাবে আপনি ইবরাহীমের প্রতি এবং ইবরাহীমের পরিবারের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত এবং মর্যাদাবান। আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবারের উপর। যেভাবে আপনি বরকত নাযিল করেছেন ইবরাহীমের পরিবারের উপর এবং ইবরাহীমের পরিবারের উপর। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত এবং মর্যাদাবান।) -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৮১৩৩মুসনাদে ইবনে আবী শাইবাহহাদীস ৫০৫

এছাড়া এ ধরনের বর্ণনা আরো অনেক সাহাবী থেকেও এসেছে। সকলে নবীজী থেকে জিজ্ঞাসা করে করে দরূদ শিখে নিয়েছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হলনবীজীর প্রতি দরূদ পেশ করার এ নির্দেশনাটিকে সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জন্য অনেক বড় তোহফা মনে করতেন। সহীহ বুখারীর বর্ণনা মতে সাহাবী হযরত কা‘ব রা. তাবেয়ী হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবী লাইলাকে বললেন-

أَلاَ أُهْدِي لَكَ هَدِيَّةً سَمِعْتُهَا مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟

আমি কি তোমাকে সেই হাদিয়া দিব নাযা আমি নবীজী থেকে লাভ করেছিএরপর তিনি তাকে দরূদে ইবরাহীম শিখিয়ে দেন।

তো সাহাবায়ে কেরাম দরূদের এ আমলকে অনেক বড় গনীমত ও উপঢৌকন মনে করতেন এবং এর কদর ও মূল্যায়ন করতেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারীহাদীস ৩৩৭০সহীহ মুসলিমহাদীস ৪০৬)

আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও করুণা বর্ষিত হয় যে কারণে

দরূদ এমন একটি আমলযার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার করুণা লাভে ধন্য হয়। বান্দা যদি আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি একবার দরূদ শরীফ পেশ করে আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদানে তার প্রতি দশ বার রহমত বর্ষণ করেন। নবীজী বলেন-

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا.

যে আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ৪০৮সুনানে আবু দাঊদহাদীস ১৫৩০সুনানে নাসায়ীহাদীস ১২৯৬মুসনাদে আহমাদহাদীস ৮৮৫৪১০২৮৭

এজন্য বুযুর্গানে দ্বীন বলে থাকেনযেকোনো মুশকিল বিষয় সামনে আসলে দরূদের প্রতি মনোযোগী হওয়া চাই। এতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি ধাবিত হয়।

নেকী হাছিল হয়গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বুলন্দ হয় দরূদের মাধ্যমে

দরূদের  মাধ্যমে যেভাবে আল্লাহর রহমত লাভ হয় তেমনি এর মাধ্যমে অর্জিত হয় বহু নেকী, মাফ হয় বান্দার গুনাহ। পাশাপাশি বুলন্দ হতে থাকে বান্দার মর্তবাও। হাদীস শরীফে এসেছে-

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ مِنْ أُمَّتِي صَلَاةً مُخْلِصًا مِنْ قَلْبِهِ، صَلَّى الله عَلَيْهِ بِهَا عَشْرَ صَلَوَاتٍ، وَرَفَعَهُ بِهَا عَشْرَ دَرَجَاتٍ، وَكَتَبَ لَهُ بِهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ، وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ.

আমার যে উম্মতী আমার প্রতি অন্তর থেকে একবার দরূদ পেশ করবে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। তার মর্তবা দশ স্তর পর্যন্ত উন্নীত করবেন। তাকে দশ নেকী দান করবেন এবং তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সুনানে কুবরানাসাঈহাদীস ৯৮৯২৯৮৯৩১২২১১০১২২সুনানে নাসাঈহাদীস ১২৯৭আমালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলাইনাসাঈহাদীস ৩৬২

নবীজীর শানে দরূদ প্রেরণের মাধ্যমে এভাবে বান্দার সগীরা গুনাহগুলো ঝরতে থাকেনেকী বৃদ্ধি পেতে থাকেদারাজাত বুলন্দ হতে থাকে। তার দেহমন পুত-পবিত্র হয় এবং আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। এক বর্ণনায় এসেছে-

صَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّهَا زَكَاةٌ لَكُمْ، وَاسْأَلُوا اللهَ لِي الْوَسِيلَةَ، فَإِنَّهَا دَرَجَةٌ فِي أَعَلَى الْجَنَّةِ، لَا يَنَالُهَا إِلّا رَجُلٌ، وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَنَا هُوَ.

তোমরা আমার প্রতি দরূদ পেশ কর। কেননা এটা তোমাদের জন্যে যাকাত স্বরূপ। আর আমার জন্য আল্লাহর নিকট ওসিলা তলব কর। কেননা এটা হচ্ছে জান্নাতের সর্বোচ্চ একটি মাকাম। যা কেবল একজনই লাভ করবে। আমি আশা করিআমিই হব সেইজন। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৮৭৭০ফাযলুস সালাত আলাননাবিয়্যি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামইসমাঈল আলকাযীহাদীস ৪৬৪৭

মোটকথাযাকাত যেভাবে সম্পদের ময়লা দূর করে তার প্রবৃদ্ধি ঘটায় তেমনি দরূদের আমলও মুমিনের দ্বীন-ঈমানকে কলুষমুক্ত করে তাতে নূর এনে দেয় এবং ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করে। তার পাপগুলো মোচন করে দেয়।

যার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয় এবং মাকসাদ হাছিল হয়

হযরত উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا ذَهَبَ ثُلُثَا اللَّيْلِ قَامَ فَقَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا اللهَ اذْكُرُوا اللهَ جَاءَتِ الرَّاجِفَةُ تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ جَاءَ المَوْتُ بِمَا فِيهِ جَاءَ المَوْتُ بِمَا فِيهِ ، قَالَ أُبَيٌّ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي أُكْثِرُ الصَّلَاةَ عَلَيْكَ فَكَمْ أَجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلَاتِي؟ فَقَالَ: مَا شِئْتَ. قَالَ: قُلْتُ: الرُّبُعَ، قَالَ: مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ، قُلْتُ: النِّصْفَ، قَالَ: مَا شِئْتَ، فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ، قَالَ: قُلْتُ: فَالثُّلُثَيْنِ، قَالَ: مَا شِئْتَ، فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ، قُلْتُ: أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِي كُلَّهَا قَالَ: إِذًا تُكْفَى هَمَّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ.

রাতের দুই প্রহর অতিক্রান্ত হলে নবীজী উঠে যেতেন। বলতে থাকতেনহে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর। তোমরা আল্লাহর যিকিরে মশগুল হও। প্রবল ঝাঁকুনি (কেয়ামত) চলে আসছে। তারপর এর পিছে আসছে আরেকটি (পুনরুত্থান)। মৃত্যু তার ভয়াবহতা নিয়ে চলে আসছে। মৃত্যু তার ভয়াবহতা নিয়ে চলে আসছে।

হযরত উবাই ইবনে কা‘ব রা. বলেন, আমি বললামইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরূদ পড়ে থাকি। আমি আমার দুআর কতটুকু সময় আপনার দরূদে ব্যয় করবনবীজী বললেনযতটুকু ইচ্ছা। আমি বললামএক চতুর্থাংশবললেনতোমার ইচ্ছা। তবে যদি এর চেয়ে বেশি কর তাহলে তোমার জন্য তা কল্যাণকর হবে। আমি বললামঅর্ধেকবললেনতোমার ইচ্ছা। তবে যদি তুমি এরচে বেশি কর তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আমি বললামতাহলে দুই তৃতীয়াংশবললেনতোমার ইচ্ছা। তবে তুমি যদি এর চেয়ে বেশি কর তাহলে তা তোমার জন্যই ভালো হবে। আমি বললামআমি আমার দুআর পূর্ণ সময় আপনার দরূদে অতিবাহিত করব। নবীজী বললেনতাহলে তোমার (দুনিয়া-আখিরাতের) প্রয়োজন পূরণ হবেপেরেশানী দূর হবে এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযীহাদীস ২৪৫৭মুসনাদে আহমাদহাদীস ২১২৪২

দরূদের শ্রেষ্ঠত্ব এ থেকেও অনুমিত হয় যেনবীজী হযরত উবাই রা.-কে বারবার বলছেন-

مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ .

(তোমার ইচ্ছা। তবে তুমি যদি এরচে বেশি কর তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।) তো যে আমলের আধিক্য কল্যাণ বয়ে আনে তা কতটা মহিমান্বিত হতে পারে!

তাছাড়া দরূদের মাধ্যমে তো নিজের জন্য কোনো কিছু চাওয়া হয় নাকেবল নবীজীর দরজা বুলন্দির জন্য দুআ করা হয়। আর তাতেই মহান মালিক এতটা খুশি হন যেন বলেনবান্দা! তুমি আমার হাবীবের জন্য দুআ করছ! তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা তলব করছ! যাওতোমার কিছু চাওয়া লাগবে না। তোমার জরুরতগুলো আমি দেখছি। আমি সেগুলো পুরা করে দিব।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই রূহ ও প্রেরণা নিয়েসেই প্রত্যাশা ও উপলব্ধি মনে জাগরূক রেখে নবীজীর ও উপলব্ধি প্রতি দরূদ ও সালাম নিবেদন করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

এজন্য মাশায়েখে কেরাম বলে থাকেনযেকোনো প্রয়োজনে দরূদের আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া চাই। কোনো পেরেশানীর সম্মুখীন হলে দরূদ শরীফ পড়তে থাক। এতে একদিকে দুশ্চিন্তা দূর হয় এবং দরূদের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত নাযিল হওয়ার কারণে কাজও সহজে সমাধান হয়ে যায়।

তেমনিভাবে কোনো ধরনের গুনাহের প্রতি যদি নফস ফুঁসলাতে থাকে তখনও দরূদ অত্যন্ত কার্যকরী একটি আমল। বান্দার যদি গুনাহ ছাড়ার মজবুত নিয়ত থাকে আর সে দরূদের আমলের ইহতিমাম করতে থাকে তাহলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই নুসরত ও সাহায্য করবেন। তখন আল্লাহর মেহেরবানীতে তার জন্য গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবেইনশাআল্লাহ।

নবীজী খুশি হয়েছেন যে সুসংবাদ লাভ করে

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন দরূদের ফযীলত পেশ করা হয় তখন তিনি এ সুসংবাদ লাভ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠেন। হযরত আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَ ذَاتَ يَوْمٍ وَالسُّرُورُ فِي وَجْهِهِ ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ إنَّا لَنَرَى السُّرُورَ فِي وَجْهِكَ؟ فَقَالَ : إِنَّهُ أَتَانِي الْمَلَكُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَمَا يُرْضِيك أنَّهُ لاَ يُصَلِّي عَلَيْك مِنْ أُمَّتِكَ أَحَدٌ إلاَّ صَلَّيْت عَلَيْهِ عَشْرًا، وَلاَ يُسَلِّمُ عَلَيْك أَحَدٌ مِنْ أُمَّتِكَ إلاَّ سَلَّمْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا؟ قَال : بَلَى.

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম (আমাদের মাঝে) আসলেন। তখন তার চেহারায় আনন্দের আভা বিরাজ করছিল। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেনইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার চেহারায় আনন্দ লক্ষ্য করছি। নবীজী বললেনআমার নিকট ফিরিশতা এসেছিল। বললইয়া মুহাম্মাদ! এ বিষয়টি কি আপনাকে আনন্দিত করবে না যে, (আপনার রব বলেছেন,) আপনার কোনো উম্মতী যদি আপনার প্রতি দরূদ পাঠ  করে তাহলে আমি (আল্লাহ) তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করব? আর কোনো উম্মতী যদি আপনার প্রতি সালাম পেশ করে তাহলে আমি তার প্রতি দশবার সালাম-শান্তি বর্ষণ করবনবীজী বললেনঅবশ্যই অবশ্যই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহহাদীস ৩২৪৪৮সুনানে নাসাঈহাদীস ১২৮৩সুনানে কুবরানাসাঈহাদীস ১২০৬১২০৭

বর্ণনায় এমনও পাওয়া যায় যেনবীজী একথা শুনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৬৬২১৬৬৩১৬৬৪)

বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আনন্দ ছিল উম্মতের স্বার্থে। কেননা যার জন্য দরূদ পড়া হয় তার অপেক্ষা যিনি দরূদ পড়েন তার নিজেরই বেশি ফায়দা। তাই এ সুসংবাদ ছিল মূলত উম্মতের জন্য সুসংবাদ। আর নবীজী যেহেতু উম্মতের কল্যাণে সদা বিভোর থাকতেন তাই এ সংবাদ শুনে তিনি এরকম আনন্দিত হয়ে পড়েছিলেন।

যতক্ষণ বান্দা দরূদ পড়তে থাকে ফিরিশতাগণ দুআ করতে থাকেন

বান্দা যতক্ষণ দরূদে থাকে ফিরিশতাগণ ততক্ষণ তার জন্য রহমতবরকত এবং মাগফিরাতের দুআ করতে থাকেন। হাদীস শরীফে এসেছে-

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً لَمْ تَزَلِ الْمَلَائِكَةُ تُصَلِّي عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَيَّ، فَلْيُقِلَّ عَبْدٌ مِنْ ذَلِكَ أَوْ لِيُكْثِرْ.

আমার উপর কেউ দরূদ পড়লে ফিরিশতাগণ তার জন্য দুআ করতে থাকে যতক্ষণ সে আমার প্রতি দরূদে রত থাকে। এখন বান্দার ইচ্ছা- বেশি বেশি দরূদ পড়বেনা কম। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৫৬৮০কিতাবুয যুহদইবনুল মুবারকহাদীস ১০২৪সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৯০৭

হাদীসের এ বক্তব্য শোনার পর আমার নিজেরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকারআমি দরূদের প্রতি কতটুকু মনোযোগী হব।

 

যার ওসিলায় দুআ কবুল হয়

দরূদের আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত প্রিয় আমল। দরূদের ওসিলায় আল্লাহ তাআলা বান্দার দুআ কবুল করেন। হযরত উমর রা. বলেন-

إِنَّ الدُّعَاءَ مَوْقُوفٌ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ يَصْعَدُ مِنْهُ شَيْءٌ، حَتَّى تُصَلِّيَ عَلَى نَبِيِّكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

আসমান যমীনের মাঝে দুআ ঝুলন্ত থাকে। তুমি তোমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পেশ করা পর্যন্ত তা উপরে ওঠে না। -জামে তিরমিযীহাদীস ৪৮৬

তাই দুআ করার একটি আদব হচ্ছেদুআর সূচনা-সমাপ্তি দরূদের মাধ্যমে করা।

নবীজীর নৈকট্য ও শাফাআত লাভ হয় যে ওসিলায়

দরূদের মাধ্যমে যেভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয় তেমনি এর মাধ্যমে অর্জিত হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য। নবীজী বলেন-

أَوْلَى النَّاسِ بِي يَوْمَ القِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلاَةً.

কেয়ামতের দিন আমার নৈকট্য লাভ করবে ঐ ব্যক্তিযে আমার প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করে। -জামে তিরমিযীহাদীস ৪৮৪

নবীজীর প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা প্রকাশের একটা মাধ্যম হল অধিক পরিমাণে দরূদ পেশ করা। অতএব যিনি নবীজীকে মহব্বত করবেন রহমতের নবী তাকে স্নেহের সাথে গ্রহণ করে নেবেন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে কিয়ামতের বিভীষিকাময় মুহূর্তে নবীজী তাকে ভুলে বসবেন- তা কি ভাবা যায়! এ বিষয়টিই উল্লেখিত হয়েছে আলোচ্য হাদীসে।

কিয়ামতের দিন নবীজীর নৈকট্য লাভ করার একটি অর্থ হলকিয়ামতের দিন সে নবীজীর শাফাআত লাভে ধন্য হবেইনশাআল্লাহ। এক বর্ণনায় এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

من صلى عَليّ حِين يصبح عشرا وَحين يُمْسِي عشرا أَدْرَكته شَفَاعَتِي يَوْم الْقِيَامَة.

قال الحافظ المنذري : رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ بِإِسْنَادَيْنِ أَحدهمَا جيد.

যে আমার প্রতি সকালে দশবার আর সন্ধ্যায় দশবার দরূদ পড়বে কিয়ামতের দিন সে আমার শাফাআত লাভ করবে। -আততারগীব ওয়াততারহীবমুনযিরীহাদীস ৯৮৭

আল্লামা মুনাভী রাহ. বলেনঅর্থাৎ সে নবীজীর বিশেষ শাফাআত লাভ করবে।

যে আমল পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত রয়েছে ফিরিশতাদের বিশেষ জামাত

আমরা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে দরূদ ও সালাম পেশ করি তখন তা পৌঁছে যায় প্রিয় নবীজীর রওযা মুবারকে সোনার মদীনায়। যে যেখানে যত দূরেই অবস্থান করুক না কেন। বান্দার দরূদের হাদিয়া পৌঁছে দেওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত রয়েছে ফিরিশতাদের বিশেষ জামাত। নবীজী বলেন-

إِنَّ لِلهِ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةً سَيَّاحِينَ، يُبَلِّغُونِي مِنْ أُمَّتِي السَّلَامَ.

আল্লাহর পক্ষ থেকে যমিনে বিচরণকারী ফিরিশতাগণ নিযুক্ত রয়েছেন। তারা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার নিকট সালাম পৌঁছায়। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৩৬৬৬৪২১০৪৩২০সুনানে নাসাঈহাদীস ১২৮২আমালুল ইয়াওমি ওয়াললাইলাহহাদীস ৬৬সুনানে কুবরানাসাঈহাদীস ১২০৬৯৮১১১১৯৩২

বর্ণনায় এও পাওয়া যায় যেদায়িত্বশীল ফিরিশতা দরূদ পেশকারীর নাম ও পিতার নামসহ দরূদের হাদিয়া নবীজীর খেদমতে পেশ করেন। কিয়ামত পর্যন্ত সকলের দরূদ নবীজীর খেদমতে এভাবে পেশ করা হতে থাকবে। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে বাযযারহাদীস ১৪২৫)

তাই উম্মতের কর্তব্য হচ্ছে দরূদের হাদিয়ার মাধ্যমে নবীজীর নিকট নিজেকে বেশি বেশি পেশ করা। এই মেযাজ ও উপলব্ধি নিয়ে যদি দরূদ পড়া হয় তাহলে নবীজীর প্রতি ঈমানী মহব্বতও বৃদ্ধি পেতে থাকবেইনশাআল্লাহ।

যে আমলে অবহেলার ব্যাপারে এসেছে কঠোর হুঁশিয়ারি

পূর্বেই আমরা যেমনটি উল্লেখ করে এসেছিআমাদের উপর নবীজীর একটি বড় হক হচ্ছে তাঁর শানে দরূদ ও সালাম নিবেদন করা। কখনো কখনো এ হক আরো জোরালো হয়। বিশেষ করে যখন নবীজীর নাম উচ্চারিত হয় তখন নবীজীর প্রতি দরূদ পড়া খুবই জরুরি। নবীজী বলেন-

رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ، وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ فَانْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ، وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ.

ঐ ব্যক্তির জন্য ধিকযার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয় আর সে আমার প্রতি দরূদ পড়ে না। ঐ ব্যক্তির জন্য ধিকযে রমাযান পেল অতঃপর তার গুনাহ মাফ হওয়ার পূর্বেই তা গত হয়ে গেল। ঐ ব্যক্তির জন্য ধিকযে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ তাদের (সেবা ও দুআ নেওয়ার) মাধ্যমে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ৭৪৫১জামে তিরমিযীহাদীস ৩৫৪৫

অতএব নবীজীর নাম শুনলে দরূদের ইহতিমাম করা খুবই জরুরি। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

البَخِيلُ الَّذِي مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ.

কৃপণ ঐ ব্যক্তিযার নিকট আমার নাম আলোচিত হল অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পড়ল না। -জামে তিরমিযীহাদীস ৩৫৪৬সুনানে কুবরানাসায়ীহাদীস ৯৮০২

নবীজী এ ধরনের ব্যক্তিকে কৃপণ বলেছেন এবং যথার্থই বলেছেন। সাধারণত কৃপণ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়যে কাউকে কিছু প্রদানের ক্ষেত্রে সঙ্কুচিত বোধ করে কিংবা প্রয়োজনের ক্ষেত্রে খরচ করতে পিছপা থাকে। কিন্তু নিজের আয়সুবিধা এবং উন্নতির ক্ষেত্রেও যদি কেউ পিছিয়ে থাকে তাহলে এর চেয়ে বোকা এবং কৃপণ আর কে হতে পারে! নবীজীর প্রতি দরূদ পাঠে তো নিজেরই ফায়দা এবং অনেক অনেক ফায়দা। তো যে নিজের ফায়দাটুকু গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেআল্লাহর রহমত ও করুণা গ্রহণে উদাস থাকে তার চেয়ে কৃপণ কে হতে পারে!

এক বর্ণনায় এসেছে-

مَنْ نَسِيَ الصَّلَاةَ عَلَيَّ،خَطِئَ طَرِيقَ الْجَنَّةِ.

যে আমার প্রতি দরূদ পেশ করতে ভুলে গেল সে জান্নাতের পথ থেকে বিচ্যুত হল। -সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ৯০৮

অর্থাৎ জান্নাতে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ঈমানের সাথে সাথে নেক আমলযদি আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী হয়। আর নেক আমলের মাঝে শ্রেষ্ঠ আমলগুলোর একটি হচ্ছে দরূদ শরীফ। তো যে ব্যক্তি দরূদের কথাই ভুলে গেল সে জান্নাতের স্বপ্ন দেখে কী করে! জান্নাতে যাওয়ার জন্য তো আমরা নবীজীর শাফাআতের মুহতাজ। সুতরাং কোনো জান্নাতপ্রত্যাশী মুমিন দরূদ থেকে গাফেল হয়ে কি শাফাআতের আশা করতে পারে! অতএব নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদেরকে যত্নবান হতে হবে দরূদ শরীফের আমলের প্রতি।

বস্তুত দরূদ শরীফের আমল এমন একটি মহিমান্বিত আমলযাতে নিহিত রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। এতে আল্লাহ তাআলার খাছ রহমত লাভ হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। নিজের দ্বীন ঈমানের তারাক্কী হয়। আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। পেরেশানী লাঘব হয়। মুশকিলাত আসান হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহানী ফায়য হাছিল হয়। নবীজীর প্রতি ঈমানী মহব্বত বৃদ্ধি পেতে থাকে। নবীজীর শাফাআত লাভের আশা করা যায়। সর্বোপরি পরকালীন সফলতার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে দরূদ শরীফের।

দরূদের আমল একজন মুমিনের মৌলিক অযিফার অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে সে হাছিল করতে পারে দুনিয়া-আখেরাতের খায়ের ও কল্যাণ এবং রহমত ও বরকত। তাই দৈনন্দিন জীবনে সকাল-সন্ধ্যায় আদায় করি দরূদের আমল। জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোতে দরূদ শরীফ পাঠ করি। হেলায় খেলায় সময় না কাটিয়ে দরূদ ও সালাম নিবেদন করতে থাকি নবীজীর খেদমতে। এভাবে আমার জীবনের খুচরা সময়গুলো সজীব হয়ে উঠুক দরূদে দরূদে।

দেড় হাজার বছর পরের আমরা। সেই পবিত্র হিজাযভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল পুবে। মাঝে পর্বত সমুদ্র ও মরু বিয়াবান। বন জঙ্গল আরো কত কী! আমাদের যাদের নসীবে জুটেনি চর্মচক্ষে তাঁকে দেখারপাইনি তাঁর ছোঁয়াদরূদ আমাদের জন্য অনেক বড় সম্বল। আমাদের প্রতি নবীজীর বে-পানাহ ইহসানের দাবিও এমন কিছুই- অন্তরের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে নিবেদন করব সালাত ও সালামের নাযরানা। এই ওসিলায়ও যদি হাছিল হয় রওযা আতহারে দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করার খোশনসীব। লাভ করার সৌভাগ্য হয় রোজ হাশরে তাঁর কৃপা-দৃষ্টি- পরিচয় দেন উম্মতী বলে। টেনে নেন কাছেহাউজে কাউসারের পাড়ে। তরিয়ে নেন সেই দুর্দিনে…। সেই শাফাআতের আশায়-

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيد.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button