আলোচ্য শিরোনামটি ইসলামের মুআমালাত অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুআমালাত ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ. তাঁর ‘মাআরিফুল হাদীস’ গ্রন্থে এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- বেচাকেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার, শিল্প, দেনা-পাওনা, আমানত, হাদিয়া, দান-ছদকা, ওসিয়ত, শ্রম, ভাড়া, মামলা-মোকাদ্দমা, সাক্ষ্যদান, ওকালতি ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত বিষয়কে এককথায় ‘মুআমালাত’ বলে।
ইসলামে মুআমালাতের মর্যাদা ও অবস্থান
ইসলামী শরীয়তে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হচ্ছে ঈমান-আকীদা, যা শুদ্ধ না হলে একজন ব্যক্তি মুসলমানই হতে পারে না। ঈমান-আকীদার পর সবচে গুরুত্বপূর্ণ হল ইবাদত-বন্দেগীর অধ্যায়। এর পরেই মুআমালাত ও মুআশারাতের স্থান। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের অধ্যায়গুলোর একটিকে আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। সকল অধ্যায় একই সুতোয় গাঁথা। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন-
مَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ خُطْبَةً قَطّ إِلّا قَالَ: إِنّهُ لا إِيمَانَ لِمَنْ لا أَمَانَةَ لَهُ وَلا دِينَ لِمَنْ لا عَهْدَ لَهُ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি -(স্বাভাবিকভাবে) এ কথাটি বলতেন- ‘যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। যার প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই তার দ্বীন নেই।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৩৮৩
অনুরূপভাবে মুসলিম শরীফের এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, যার উপার্জন হারাম আল্লাহ পাক তার দুআ কবুল করেন না। (হাদীস ১০১৫)
অন্য এক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন,
لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلَا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ.
ওযু ছাড়া নামায কবুল হয় না; আর আত্মসাতের (অর্থাৎ অবৈধভাবে উপার্জিত) সম্পদের ছদকাও কবুল হয় না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ১
সুতরাং ঈমান-আকীদা ও ইবাদতের সাথে মুআমালাতের যোগসূত্র অতি গভীর ও সুদৃঢ়। ইসলামী শরীয়তে অনেক দিক থেকেই মুআমালাতের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। এই সীমিত পরিসরে শুধু চারটি দিক নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
এক. মুআমালাত অধ্যায়টি শরীয়তে ইসলামীর একটি বিস্তৃত অধ্যায়। ইসলামী আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ শাস্ত্র) গ্রন্থাদি খুললেই দেখা যাবে, এই অধ্যায়ের আলোচনা কতটা বিস্তৃত।
একজন মুসলমানের গোটা জীবনে মুআমালাতের বিধি-নিষেধ সবচে বেশি পরিমাণ দরকার পড়ে। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে হলে তাকে সবার সাথে ওঠা-বসা, লেনদেন করেই চলতে হয়। লেনদেনের মাধ্যমে জীবন যাপন করা ছাড়া কারো পক্ষে ঠিকমতো ইবাদত-বন্দেগী পালনও সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শরীয়তে মুআমালাত ও লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এর জন্য বিপুল পরিমাণে স্বতন্ত্র বিধান দেওয়া হয়েছে।
দুই. ইসলামী শরীয়তে হকসমূহ (অধিকার ও দায়-দায়িত্ব) দুই ভাগে বিভক্ত। ১. আল্লাহ পাকের হক। ২. বান্দার হক। আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে যদি বান্দার কোনো ত্রুটি হয়ে যায়; আর সে তওবা করে নেয় অথবা ক্ষেত্র বিশেষে তওবা ছাড়াও যদি আল্লাহর মর্জি হয়; তবে সে ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু বান্দার হকের ব্যাপারে কেউ ত্রুটি করলে সেটা আল্লাহ ক্ষমা করেন না; যতক্ষণ না অপরাধী নিজেই হকদারের সাথে লেনদেন সাফ করে নেয়।
তিন. ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মুআমালাতের বিধি-নিষেধ মেনে চললে ইসলাম তার জন্য আলাদা পুরস্কার ও সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
التّاجِرُ الصّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشّهَدَاءِ.
সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, ছিদ্দীক ও শহীদদের সাথে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯; সুনানে দারেমী, হাদীস ২৫৪২
চার. ইসলামী শরীয়তে মুআমালাতের বিশেষ গুরুত্বের আরেকটি দিক হল, এটি আল্লাহ কর্তৃক বান্দার পরীক্ষার এক কঠিন ময়দান। কেননা অন্যান্য ময়দানের তুলনায় এখানে বান্দার পার্থিব কল্যাণ ও প্রবৃত্তির চাহিদা একটু বেশিই বিদ্যমান। ফলে শরীয়তের বিধি-বিধানের সাথে নফসের মোজাহাদা ও দ্বন্দ্বও হয় বেশি। উদাহরণ স্বরূপ : ব্যবসা-বাণিজ্যে বান্দার নিজস্ব উপকারিতা বেশি নজরে আসে। প্রবৃত্তির টানও এই থাকে যে, সত্য-মিথ্যা, জায়েয-নাজায়েযের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যেভাবে লাভ বেশি হয় সেই পন্থাই অবলম্বন করা। কিন্তু আল্লাহ তাআলার বিধান বলে, খবরদার! বাহ্যিকভাবে তোমার বিরাট ক্ষতি হয় হোক, তবুও তুমি মিথ্যা, ওজনে কম দেওয়া, ভেজাল অথবা কারো সাথে প্রতারণা করতে পারবে না। আল্লাহ পাক তোমার জন্য যে পন্থা হালাল করেছেন তুমি সেটাই অবলম্বন করবে।
কুরআন মাজীদে লেনদেনে পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ
কুরআন-হাদীসে অতি গুরুত্বের সাথে লেনদেনে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে ও নানা আঙ্গিকে এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এখানে তার কিছু নমুনা পেশ করা হল।
সূরা মুতাফ্ফিফীনের শুরুতেই আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
وَیْلٌ لِّلْمُطَفِّفِیْنَ، الَّذِیْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَی النَّاسِ یَسْتَوْفُوْنَ، وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَ، اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓىِٕكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ، لِیَوْمٍ عَظِیْمٍ، یَّوْمَ یَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে এক মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে। -সূরা মুতাফ্ফিফীন (৮৩) : ১-৬
ইয়াতিমদের সম্পদ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে কুরআন মাজীদে লেনদেনের অনেক বড় মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اٰتُوا الْیَتٰمٰۤی اَمْوَالَهُمْ وَ لَا تَتَبَدَّلُوا الْخَبِیْثَ بِالطَّیِّبِ وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَهُمْ اِلٰۤی اَمْوَالِكُمْ اِنَّهٗ كَانَ حُوْبًا كَبِیْرًا.
ইয়াতিমদেরকে তাদের সম্পদ দিয়ে দাও। আর ভালো মালকে মন্দ মাল দ্বারা পরিবর্তন করো না। তাদের (ইয়াতিমদের) সম্পদকে নিজেদের সম্পদের সাথে মিশিয়ে খেয়ো না। নিশ্চয়ই তা মহাপাপ। -সূরা নিসা (৪) : ২
এক আয়াতে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েছেন-
اِنَّ الَّذِیْنَ یَاْكُلُوْنَ اَمْوَالَ الْیَتٰمٰی ظُلْمًا اِنَّمَا یَاْكُلُوْنَ فِیْ بُطُوْنِهِمْ نَارًا وَ سَیَصْلَوْنَ سَعِیْرًا.
নিশ্চয়ই যারা ইয়াতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে; তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভর্তি করে। তারা অচিরেই এক জ¦লন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। -সূরা নিসা (৪) : ১০
এক আয়াতে পরস্পর সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বেচাকেনাকে বৈধতা দিয়ে সম্পদ উপার্জনের অন্য সব অন্যায় পদ্ধতিকে হারাম ঘোষণা করেছেন। বলেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْكُمْ .
হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনো ব্যবসা করা হলে (তা জায়েয)। -সূরা নিসা (৪) : ২৯
কোনো সম্পদ শুধু বিচারকের কাছ থেকে নিজের নামে ফায়সালা করে নিলেই তা বৈধ হয়ে যায় না; বরং পন্থাও বৈধ হতে হয় এবং বাস্তবেই নিজে ঐ সম্পদের হকদার হতে হয়। এ বিষয়ে কুরআনের এক আয়াতে নির্দেশনা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَ تُدْلُوْا بِهَاۤ اِلَی الْحُكَّامِ لِتَاْكُلُوْا فَرِیْقًا مِّنْ اَمْوَالِ النَّاسِ بِالْاِثْمِ وَ اَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.
তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনে-শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৮
ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন সময় আমরা যে চুক্তি করি তা পূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ.
হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গিকার পুরা করো। অর্থাৎ লেনদেনের বিভিন্ন অঙ্গিকার ও অন্যান্য অঙ্গিকার। -সূরা মায়েদা (৫) : ১
অনেকে আমাদের কাছে বিভিন্ন জিনিস আমানত রাখে। আবার বিভিন্ন সময় নানা প্রয়োজনে আমরাও অনেক কিছু ধার-কর্জ করি। অথবা যে কোনোভাবে অপরের কোনো জিনিস আমাদের কাছে থাকে; এ অবস্থায় পাওনাদারের জিনিস বিশ্বস্ততার সাথে তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ اللهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهْلِهَا، وَ اِذَا حَكَمْتُمْ بَیْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوْا بِالْعَدْلِ، اِنَّ اللهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمْ بِهٖ، اِنَّ اللهَ كَانَ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا.
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানত ও পাওনা তার হকদারকে আদায় করে দেবে। আর যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে; ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কতই না উৎকৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা নিসা (৪) : ৫৮
খাঁটি মুুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে দুই জায়গায় ইরশাদ করেছেন-
وَ الَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَ عَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ، وَ الَّذِیْنَ هُمْ بِشَهٰدٰتِهِمْ قَآىِٕمُوْنَ.
এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা তাদের সাক্ষ্য যথাযথভাবে দান করে। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ৩২-৩৩; সূরা মুমিনূন (২৩) : ৮
লেনদেনে অস্বচ্ছতার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর হুঁশিয়ারি
উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে যে বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা হচ্ছে, মাপে কম না দেওয়া, ভালো মালের সাথে খারাপ মাল না মেশানো, ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ না করা, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদে দখলদারি না করা, ক্রয়-বিক্রয়সহ মুআমালাতের বিভিন্ন চুক্তি যথাযথভাবে পুরা করা, আমানতসমূহ তার হকদারের কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও মুআমালাতের বহু ক্ষেত্র রয়েছে, যেগুলোতে সঠিকভাবে আদায় করা একজন মুমিনের কর্তব্য। কেননা মুআমালা বান্দার হক। তাতে ত্রুটি হওয়ার অর্থই বান্দার হক নষ্ট করা। তার প্রতি যুলুম করা। আর জুলুম ও অপরিচ্ছন্ন মুআমালার ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে পাকে কঠিন সতর্কবাণী শুনিয়েছেন। এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হচ্ছে।
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَيْءٍ، فَلْيَتَحَلّلْهُ مِنْهُ اليَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ.
যেই ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার উপর জুলুম করেছে। সে যেন আজই তার সাথে মুআমালা সাফ করে নেয়; সেই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার যুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে (এবং পাওনাদারকে আদায় করা হবে।) আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার উপর যুলুম করেছে তার পাপের বোঝা যুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৯
একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? তারা বললেন, যার অর্থ-সম্পদ নেই আমরা তো তাকেই নিঃস্ব মনে করি। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের ময়দানে নামায, রোযা, যাকাত(সহ অনেক নেক আমল) নিয়ে হাযির হবে; কিন্তু সে হয়ত কাউকে গালি দিয়েছে বা কারো উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে বা কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে বা কাউকে খুন করেছে অথবা কাউকে আঘাত করেছে। ফলে প্রত্যেককে তার হক অনুযায়ী এই ব্যক্তির নেক আমল থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদি কারও হক বাকি থেকে যায় আর এই ব্যক্তির নেক আমল শেষ হয়ে যায় তাহলে হকদার ব্যক্তির পাপ পাওনা অনুসারে এই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। ফলে সে এই পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৮
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের ময়দানে কোনো বান্দা তার এক পাও নড়াতে পারবে না; যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে- ১. সে তার জীবন কোন্ পথে শেষ করেছে। ২. যতটুকু ইলম শিখেছে তার উপর কতটুকু আমল করেছে। ৩. সম্পদ কোন্ পথে আয় করেছে। ৪. এবং কোন্ পথে ব্যয় করেছে। ৫. নিজের যৌবনকে কোন্ পথে শেষ করেছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৭
সুতরাং আমরা যখন সম্পদের আয়-ব্যয়ের হিসাব করি তখন কোন্ পথে আয় করছি এবং কোন্ পথে ব্যয় করছি সেটারও হিসাব নেওয়া দরকার।
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
وَالّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ حَبْلَهُ، فَيَذْهَبَ إِلَى الْجَبَلِ، فَيَحْتَطِبَ، ثُمّ يَأْتِيَ بِهِ يَحْمِلُهُ عَلَى ظَهْرِهِ، فَيَبِيعَهُ فَيَأْكُلَ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النّاسَ، وَلَأَنْ يَأْخُذَ تُرَابًا فَيَجْعَلَهُ فِي فِيهِ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَجْعَلَ فِي فِيهِ مَا حَرّمَ اللهُ عَلَيْهِ.
আমার প্রাণ যার হাতে তাঁর কসম, তোমাদের কেউ মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম হল সে তার রশি নিয়ে পাহাড়ে যাবে এবং কাঠ সংগ্রহ করবে। অতপর তা পিঠে বহন করে এনে বিক্রি করবে এবং আহারের ব্যবস্থা করবে। আর তোমাদের কেউ হারাম খাওয়ার চেয়ে উত্তম হল নিজের মুখের মধ্যে মাটি ভরা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৯০, শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৭৬৩
অন্যের অবৈধ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কঠোরতা
কোনো মুমিন নিজে তো অস্বচ্ছ ও অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জন করবেই না। এমনকি অন্যের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদও সে ব্যবহার করবে না।
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنِ اشْتَرَى سَرِقَةً، وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهَا سَرِقَةٌ، فَقَدْ شُرِكَ فِي عَارِهَا وَإِثْمِهَا.
যে ব্যক্তি জেনেশুনে চুরি করে আনা মাল ক্রয় করল, সেও চুরির পাপের মধ্যে শামিল হল। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২২৫৩
লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে দুআ-ইবাদত কবুল হয় না
আমরা নামায-রোযাসহ অন্যান্য ইবাদত পালন করি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তিনি সেই আমলের দ্বারাই সন্তুষ্ট হন, যে আমল তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য। যে ব্যক্তি অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে তার প্রয়োজন পুরা করে; আল্লাহ পাক তার ইবাদত-বন্দেগী ও দুআ-মুনাজাত কবুল করেন না। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَيّهَا النّاسُ، إِنّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلّا طَيِّبًا، وَإِنّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: يَا أَيّهَا الرّسُلُ كُلُوا مِنَ الطّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيم وَقَالَ: يَا أَيّهَا الّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ ثُمّ ذَكَرَ الرّجُلَ يُطِيلُ السّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟
নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (আমল) ছাড়া গ্রহণ করেন না। তিনি রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন; একই আদেশ করেছেন মুমিনদেরকে। তিনি বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا.
(হে রাসূলগণ! আপনারা উত্তম (হালাল) রিযিক থেকে আহার করুন এবং নেক আমল করুন।)
তিনি মুমিনদেরকেও বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ.
(হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার প্রদত্ত হালাল রিযিক থেকে আহার কর।)
অতপর নবীজী একজন লোকের বর্ণনা দিলেন; যে দীর্ঘ সফর করেছে। চুলগুলো এলোমেলো, শরীর ধূলি ধূসরিত। আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে দুআ করছে- হে আমার রব! হে আমার রব!! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম; তাহলে কীভাবে তার দুআ কবুল হবে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৯
ইবনে রজব হান্বলী রাহ. হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এই হাদীসে উদাহরণস্বরূপ শুধু দুআর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা হারাম দ্বারা প্রতিপালিত হলে তার কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৮৫
আল্লাহ তাআলা অবৈধ সম্পদের দান কবুল করেন না
ইসলামের সুস্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে কেবলমাত্র নেক আমলই বদ আমলকে নির্মূল করে। বদ আমল কখনো অন্য বদ আমলকে নির্মূল করতে পারে না। অর্থাৎ আমরা দান-সদকা, যাকাত-ফিতরা আদায় করি, যাতে আমাদের পাপ মোচন হয় এবং সম্পদ পবিত্র হয়। কিন্তু এ কাজ পাপের পথে অর্জিত সম্পদ দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করাই একটি পাপ। সুতরাং সেই পাপ দ্বারা অন্য পাপ মাফ হওয়ার আশা নেই। তেমনই অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ অপবিত্র, সুতরাং তা দ্বারা নিজের সম্পদ পবিত্র করাও অসম্ভব। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
لَا يَكْسِبُ عَبْدٌ مَالًا مِنْ حَرَامٍ، فَيُنْفِقَ مِنْهُ فَيُبَارَكَ لَهُ فِيهِ، وَلَا يَتَصَدّقُ بِهِ فَيُقْبَلَ مِنْهُ، وَلَا يَتْرُكُ خَلْفَ ظَهْرِهِ إِلّا كَانَ زَادَهُ إِلَى النّارِ، إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ لَا يَمْحُو السّيِّئَ بِالسّيِّئِ، وَلَكِنْ يَمْحُو السّيِّئَ بِالْحَسَنِ، إِنّ الْخَبِيثَ لَا يَمْحُو الْخَبِيثَ.
এমন হবে না যে, কোনো বান্দা হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করবে অতপর তা থেকে (বৈধ ও নেক কাজে ) খরচ করবে আর তাতে বরকত দান করা হবে। সে তা থেকে সদকা করবে আর তা কবুল করা হবে। বরং ঐ ব্যক্তি ঐ সম্পদ (মিরাছ হিসাবে) তার মৃত্যুর পর রেখে গেলেও তা তাকে আরো বেশি করে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পাপ দ্বারা অপর পাপকে নির্মূল করেন না। তবে নেক আমল দ্বারা পাপকে নির্মূল করেন। নিশ্চয়ই নাপাক বস্তু অপর নাপাক বস্তুর নাপাকি দূর করতে পারে না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৬৭২; মুসনাদে বায্যার, হাদীস ২০২৬
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا يَقْبَلُ اللهُ صَلَاةً بِغَيْرِ طُهُورٍ، وَلَا صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ.
আল্লাহ পাক পবিত্রতা ব্যতীত নামায কবুল করেন না এবং আত্মসাতের মালের ছদকা কবুল করেন না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ১; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৩৯
এর বিপরীতে হালাল ও বৈধ সম্পদ সদকা করার ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَنْ تَصَدّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاّ الطّيِّبَ، وَإِنّ اللهَ يَتَقَبّلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ، كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوّهُ، حَتّى تَكُونَ مِثْلَ الجَبَلِ.
আল্লাহ পাক কেবল (হারামের মিশ্রণ থেকে) পবিত্র বস্তুই কবুল করেন। যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে এক মুষ্ঠি খেজুরও দান করে আল্লাহ পাক তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। অতপর তা ঐ ব্যক্তির জন্য প্রতিপালন করতে থাকেন। যেমন তোমাদের কেউ উটের বাচ্চা প্রতিপালন করে। বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় ঐ সামান্য খেজুরমুষ্ঠি পাহাড়সম হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৪
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا أَدّيْتَ زَكَاةَ مَالِكَ، فَقَدْ قَضَيْتَ مَا عَلَيْكَ فِيهِ، وَمَنْ جَمَعَ مَالًا حَرَامًا، ثُمّ تَصَدّقَ بِهِ، لَمْ يَكُنْ لَهُ فِيهِ أَجْرٌ، وَكَانَ إِصْرُهُ عليه.
যখন তুমি তোমার সম্পদের যাকাত আদায় করলে তখন তুমি এ সম্পদের ব্যাপারে তোমার অবশ্যকরণীয় বিধান পালন করলে। যে ব্যক্তি হারাম মাল উপার্জন করবে অতপর তা সদকা করবে সেই সদকায় তার কোনো সওয়াব হবে না; বরং অবৈধ উপার্জনের পাপের বোঝা তার ঘাড়ে চেপেই থাকবে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩২১৬; আলমুনতাকা, ইবনুল জারূদ, হাদীস ৩৩৬; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৪৪০
তাবেঈ কাসেম বিন মুখায়মিরাহ রাহ. (সাহাবীর মধ্যস্থতা উল্লেখ না করে সরাসরি রাসূলের থেকে) যেসকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তার একটি হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো পাপের পথে সম্পদ উপার্জন করল অতপর তা আত্মীয়তা রক্ষায় খরচ করল বা সদকা করল অথবা তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল; তাহলে (কিয়ামতের মাঠে) এসবকিছুই একত্রিত করা হবে অতপর তা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। -কিতাবুল মারাসীল, আবু দাউদ, হাদীস ১৩১
বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি এখন নেক আমল করছে; তবে পূর্বে যুলুম-অত্যাচার করত এবং হারাম গ্রহণ করত। এখন সে নেকদিলে তওবা করে পূর্বের সেই সম্পদ দিয়ে হজ্ব করল, গোলাম আযাদ করল এবং আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা করল (তার ব্যাপারে কী বলেন?)। জবাবে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই নাপাকী অপর নাপাকীকে দূর করতে পারে না। -মুসনাদে বায্যার, হাদীস ৯৩২
সুতরাং যারা হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করে আর মনে মনে ভাবে, এখান থেকে কিছু সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেব; ব্যস, সাত খুন মাফ, তাদের উচিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীগুলো ভালোভাবে স্মরণ রাখা।
এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর একটি বড় শিক্ষণীয় ঘটনা আছে। তাঁর সময়ে বসরার আমীর ছিল আব্দুল্লাহ বিন আমের। সে মুসলমানদের বায়তুল মাল থেকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গ্রহণ করত। কিন্তু তার স্বভাব ছিল, সে এসব সম্পদ গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিত, মসজিদ নির্মাণের কাজে খরচ করত, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করত। যখন সে মৃত্যুশয্যায় উপনীত হল তখন লোকজন তার চারপাশে ভিড় জমাল এবং তার দান-দাক্ষিণ্য ও মানুষের প্রতি তার অনুগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগল। কিন্তু ইবনে ওমর রা. চুপচাপ রইলেন। যখন বসরার আমীর ইবনে আমের স্বয়ং তাঁকে কথা বলতে ও নিজের জন্য দুআ করতে আবেদন করল; তখন তিনি তাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস শোনালেন-
إِنّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى لَا يَقْبَلُ صَدَقَةً مِنْ غُلُولٍ.
আল্লাহ পাক আত্মসাতের মালের ছদকা কবুল করেন না। অতপর তাকে বললেন, তুমি তো বসরা শহরেরই আমীর ছিলে। অর্থাৎ আমি তোমার কীর্তি-কর্ম সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত যে, তুমি বায়তুল মালের সম্পদ না-হকভাবে গ্রহণ করতে। সুতরাং কীভাবে তোমার এসকল দান-সদকা কবুল হবে? আর তোমার জন্যে দুআ করলে সেই দুআই বা কীভাবে কবুল হবে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৭০০, ৫৪১৯; জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৮৯
হারাম হতে সৃষ্ট শরীর জান্নাতে যাবে না
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِنّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنّةَ لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْت، النّارُ أَوْلَى بِهِ.
এমন শরীর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪৪১; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীস ২০৭১৯; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদীস ১১৩৮
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত কা‘ব বিন উজরাহ রা.-কে ডেকে বললেন, হে কা‘ব! শুনে রাখো, ঐ দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম হতে সৃষ্ট। কেননা জাহান্নামের আগুনই তার অধিক উপযোগী। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৬১৪; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, ১৯/২১২
হারাম মাল সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করার প্রসঙ্গ
ইসলামের অমোঘ বিধান তো হল, কেউ হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করবে না। কিন্তু এরপরেও যদি কেউ শয়তােেনর ধোঁকায় অন্যায় পথে সম্পদ উপার্জন করে ফেলে অথবা কোনোভাবে যদি হারাম সম্পদ কারো কাছে জমা হয়ে যায়। তাহলে তার জন্য এই পাপ থেকে তওবা করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে তওবার অপরিহার্য একটি শর্ত হল, যার হক নষ্ট হয়েছে তার হক যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়া। এ অবস্থায় তওবাকারীর সামনে স্বাভাবিকভাবে কয়েকটি ছুরত আসে। এক. তওবাকারী নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হক নষ্ট করেছে। এক্ষেত্রে সে যেভাবেই হোক পাওনাদারের হক তার কাছেই পৌঁছে দেবে। বিখ্যাত তাবেঈ হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন,
مَنِ احْتَازَ مِنْ رَجُلٍ مَالاً، أَوْ سَرَقَ مِنْ رَجُلٍ مَالاً، وَأَرَادَ أَنْ يَرُدّهُ إلَيْهِ مِنْ وَجْهٍ لاَ يَعْلَمُ فَأَوْصَلَهُ إلَيْهِ : فَلا بَأْسَ.
যে ব্যক্তি কারো কোনো সম্পদ (অন্যায়ভাবে) কুক্ষিগত করল, অথবা কারো থেকে কোনো কিছু চুরি করল অতপর এমন পদ্ধতিতে সেই সম্পদ তার কাছে পৌঁছে দিতে চাইল যাতে সে জানতে না পারে; তাহলে সে তা করতে পারবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৩৫৯৬
দুই. সুনির্দিষ্টভাবে কারো হক নষ্ট করেনি বরং জনগণের সম্মিলিত হক নষ্ট করেছে। তাহলে আল্লামা ইবনুল জাওযী রাহ.-এর ভাষ্যমতে যেই খাত থেকে অন্যায়ভাবে নিয়েছে সেখানেই হক পৌঁছে দেবে। যেমন: রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়ে থাকলে সেখানে পৌঁছে দেবে। এই সম্পদ গরিবদের মাঝে সদকা করলে হবে না। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ: ২৬৬
তিন. কারো হক নষ্ট করা ছাড়া শরীয়ত কর্তৃক হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদের মালিক হয়েছে। যেমন: শূকর, মদ ইত্যাদি বিক্রয় করা সম্পদ। জুয়ার মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ। শরীয়তের অনুনোমোদিত পন্থায় ক্রয়কৃত সম্পদ। এক্ষেত্রে বিধান হল, ঐ সম্পদ সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দেবে।
চার. তওবাকারী কার থেকে বা কোন্ খাত থেকে নিয়েছে তা জানে না। তার পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। তাহলে পূর্বের ছুরতের ন্যায় এক্ষেত্রেও সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দেবে।
এক ব্যক্তি বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত আতা রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করেন, আমি যখন অল্প বয়স্ক ছিলাম তখন এমন পন্থায় মাল উপার্জন করতাম, যা আমি এখন পছন্দ করি না (অর্থাৎ অবৈধ পন্থায়)। আমি তওবা করতে চাই। তখন তিনি তাকে বললেন,
رُدّهَا إلَى أَهْلِهَا ، قَالَ : لاَ أَعْرِفُهُمْ، قَالَ : تَصَدّقْ بِهَا، فَمَا لَكَ فِي ذَلِكَ مِنْ أَجْرٍ، وَمَا أَدْرِي هَلْ تَسْلَمُ مِنْ وِزْرِهَا أَمْ لاَ ؟
তুমি এ মাল তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। সে বলল, আমি তো এখন তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। তিনি বললেন, তাহলে তা সদকা করে দাও। এতে তোমার কোনো সওয়াব হবে না। তুমি এর গোনাহ থেকে মুক্তি পাবে কি না তাও বলতে পারব না। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৩৫৯৪
হযরত মুজাহিদ রাহ. থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ হারাম মাল সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত সদকা করে দিবে। তবে এই সদকার বিধান তখনই প্রযোজ্য যখন হকদারের কাছে তা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। নতুবা আসল বিধান হল পাওনা তার হকদারকে পৌঁছে দেওয়া।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে লেনদেনে পরিচ্ছন্ন হওয়ার এবং বান্দার হকের বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফীক দান করুন। হালাল উপার্জনে বরকত দান করুন, হারাম থেকে রক্ষা করুন।