ইসলাম

মুহাররম ও আশুরা : গুরুত্ব ও ফযীলত

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

মাহে যিলহজ্ব গত হয়ে শুরু হতে যাচ্ছে মুহাররম মাস। হতে যাচ্ছে একটি বছরের বিদায় আর একটি বছরের সূচনা। পশ্চিমাকাশে হেসে উঠবে মুহাররমের হেলাল- নতুন বছরের নতুন চাঁদ। জগদ্বাসীকে ডেকে বলবে- বিগত দিনের হিসাব মেলাও। প্রত্যয় গ্রহণ কর নতুন বছরের। পাথেয় সংগ্রহ কর পরকালের।

দিন যায় রাত আসে। সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আসে। ধীরে ধীরে তা-ও ফুরিয়ে যায়। এভাবে বারটি মাস ঘুরতেই কেটে যায় একটি বছর। শুরু হয়ে যায় আবার নতুন বছরের আয়োজন। এভাবে একদিন নিভে আসে জীবন-বাতি। বুদ্ধিমান তো সে-ই যে জীবনের এ মূল্যবান সময়গুলো যথাযথ কাজে লাগায়।

প্রাত্যহিক জীবনে দিন-রাতের এ পরিক্রমা অনেকের কাছেই অনেকটা স্বাভাবিক। তবে জ্ঞানীদের জন্য এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের বহু উপলক্ষ রয়েছে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَاخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآياتٍ لأولِي الأَلْبَابِ .

নিশ্চয়ই আকাশম-ল ও পৃথিবীর সৃজনে এবং পালাক্রমে রাত-দিনের আগমনে বহু নিদর্শন আছে ওই সকল বুদ্ধিমানদের জন্য…। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-

إِنَّ فِي اخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا خَلَقَ اللهُ فِي السَّمَاوَاتِ والأرض لآياتٍ لِقَوْمٍ يَتَّقُونَ .

নিশ্চয়ই দিন-রাতের একের পর এক আগমনে এবং আল্লাহ আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা-কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে সেই সকল লোকের জন্য বহু নিদর্শন উপস্থিত রয়েছেযাদের অন্তরে আছে অল্লাহর ভয়। -সূরা ইউনুস (১০) : ৬

আল্লাহ তাআলা আরো চমৎকার উপস্থাপনে বলেন-

تَبٰرَكَ الَّذِیْ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ جَعَلَ فِیْهَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیْرًا .وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا.

কত মহান সেই সত্তাযিনি আসমানে ‘বুরূজ’ সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে স্থাপন করেছেন উজ্জ্বল প্রদীপ এবং আলো বিস্তারকারী চাঁদ। এবং তিনিই সেই সত্তাযিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন; (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্যযে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬১৬২

তবে বাস্তব কথা হলকেউ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেকেউ করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلّ النّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا.

প্রতিটি মানুষ সকাল যাপন করেঅতঃপর নিজেকে বিক্রি করে। এভাবে কেউ নিজেকে (আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করে জীবনকে ধ্বংস থেকে) রক্ষা করে। আর কেউ (নফস ও শয়তানের আনুগত্যে নিয়োজিত হয়ে) নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। -সহীহ মুসলিমহাদীস ২২৩

বুদ্ধিমান তো সেইযে প্রতিটি নতুন সময় ও সূচনায় নিজেকে এমন কাজে নিয়োজিত করেযার মাধ্যমে তার আখেরাত সুন্দর হয়। আর নির্বোধ ওই ব্যক্তিযে নতুন সময় ও সূচনায় এমন কাজকর্মে লিপ্ত থাকেযা তার ধ্বংস টেনে আনে। তাই জীবনের প্রতিটি নতুন মুহূর্তে কল্যাণের দিকে আরো ধাবিত হওয়ার প্রত্যয় গ্রহণ করাই মুমিনের ঈমানের দাবি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক নসীব করুন।

মুহাররম : আল্লাহ্ তাআলার নির্ধারিত সম্মানিত মাস এবং হিজরী বর্ষের প্রথম মাস

হিজরী বর্ষের সর্বপ্রথম মাস- মুহাররামুল হারাম তথা মুহাররম মাস। হাদীসের ভাষায়- শাহরুল্লাহ আলমুহাররাম। আল্লাহ তাআলা বছরের যে ক’টি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মুহাররম তার অন্যতম। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ. فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …

আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।… -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

এ চার মাস কী কীহাদীস শরীফে তা বলে দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছেআসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণজাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমতো মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদযিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজবযা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। -সহীহ বুখারীহাদীস ৪৬৬২

হাদীসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিতনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬৩

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَأَفْضَلُ الْأَشْهُرِ شَهْرُ اللهِ الَّذِي تَدْعُونَهُ الْمُحَرّمُ.

(রমযানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাসযাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক। -সুনানে কুবরানাসাঈহাদীস ৪২১৬

প্রকৃতপক্ষে  সকল মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মাঝে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরীফকে বিশেষভাবে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কীকারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মুহাররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হিজরী সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন-

یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ.

লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদেরকে বলে দিনএটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) হিসাব এবং হজ্বের সময় নির্ধারণ করার জন্য। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৯

মুসলমানদের বহু দ্বীনী বিষয়বিশেষ করে হজ্বের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের উপর। আরবী মাস-বছরকে ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবী হিজরী চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মুহাররম। মুহাররমকে ঘিরেও রয়েছে শরীয়তের সুন্দর সুন্দর বিধান ও আমল। ফলে দ্বীনী দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরী মাস-বর্ষের গণনা এবং এর শুরু-শেষের হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য সবিশেষ কাম্য।

নতুন চাঁদ নতুন প্রত্যয়দুআ পড়ে নিই নতুন বছরের

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে এই দুআ পড়তেন-

اللهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلامَةِ وَالْإِسْلامِ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ.

আয় আল্লাহআপনি এই হিলালকে আমাদের জন্য ঈমান ও ইসলাম এবং শান্তি ও বরকতের সঙ্গে উদিত করুন। আমার ও তোমার রব আল্লাহ। -জামে তিরমিযীহাদীস ৩৪৫১মুসনাদে আহমাদহাদীস ১৩৯৭

এ দুআটি যে কোনো মাসের নতুন চাঁদ দেখে পড়ার জন্য। এ হিসাবে যদি মুহাররমের চাঁদ দেখে এ দুআ পড়া হয় তাহলে নতুন চাঁদের সাথে সাথে নতুন বছরের দুআও হয়ে যাবে।

অবশ্য ইমাম আবুল কাছেম বাগাভী রাহ. (৩১৭ হি.) ‘মু‘জামুস সাহাবা’ কিতাবে সহীহ সনদে নতুন মাস ও নতুন বছরের শুরুতে পড়ার একটি দুআ উল্লেখ করেছেন। সাহাবী আবদুল্লাহ বিন হিশাম রা. বলেনসাহাবায়ে কেরাম নতুন মাস বা নতুন বছর শুরুর এ দুআটি তেমন গুরুত্ব দিয়ে শিখতেনযেভাবে কুরআনুল কারীম শিখতেন। দুআটি হল-

اللّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ وَالِإيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالإِسْلَامِ وَجِوَارٍ مِنَ الشَّيطَانِ وَرِضوَانٍ مِنَ الرَّحْمنِ.

(قال الحافظ ابن حجر في الإصابة : وهذا موقوف على شرط الصحيح.)

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস/বছরের আগমন ঘটান- শান্তি ও নিরাপত্তা এবং ঈমান ও ইসলামের (উপর অবিচলতার) সাথেশয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে। (দ্রষ্টব্য : মুজামুস সাহাবাহ ৩/৫৪৩বর্ণনা ১৫৩৯আলইসাবাহ ৪/২৫৬)

এ দুআর ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে- এটি নতুন বছরের দুআ। আর সাহাবায়ে কেরামও এ দুআটির প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন।

অতএব ঈমান-ইসলামশান্তি-নিরাপত্তা ও রহমত-বরকতের সাথে কীভাবে আমার নতুন বছরটি অতিবাহিত হতে পারে- এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকাই হচ্ছে নতুন চাঁদের বার্তা। বিশেষ করে শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথ অবলম্বন করা এবং নিজের ঈমানী যিন্দেগী প্রাণবন্ত করে তোলাই হবে আমার আগামী দিনের প্রত্যয়। তাই এখনই সংকল্পবদ্ধ হই- আমার ঈমান-আমলস্বভাব-চরিত্রচিন্তা-দর্শনমন-মানসিকতাবোধ-উপলব্ধি সর্বোপরি একজন মুমিন-মুসলমান হিসাবে আমার জীবন যাপন যেন বিগত দিনের তুলনায় আরো বেগবানফলপ্রসূসমৃদ্ধ এবং সাফল্যমণ্ডিত হয়।

এ মাসে মনোযোগী হই রোযার প্রতি

পূর্বেই আমরা যে হাদীসটি উল্লেখ করে এসেছি- হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিতনবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬৩

এ হাদীস থেকে মুহাররমের ব্যাপারে দুটি কথা পাওয়া যায় :

এক. মুহাররম মাস আল্লাহর মাস। সম্মানিত ও মহিমান্বিত মাস।

দুই. এর সম্মান রক্ষা এবং এ থেকে যথাযথ উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছেএ মাসে রোযা রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া।

কাজেই মুহাররম মাসে রোযা রাখার প্রতি আমরা মনোযোগী হতে পারি। বিশেষ করে দশ মুহাররম আশুরার রোযার কথা তো হাদীসে গুরুত্বের সাথেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রতিও আমরা বিশেষভাবে খেয়াল রাখব।

এ মাসে গুরুত্ব দেই তাওবার প্রতি

তাওবা-ইস্তিগফার যে কোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। বান্দা আল্লাহর দরবারে ধরনা দেবে এবং নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে- এতেই তো তার বন্দেগীর শান। তবে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন রয়েছেযখন তাওবার পরিবেশ আরো অনুকূল হয়। বান্দার উচিত আল্লাহর দেওয়া সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো লুফে নেওয়া এবং আল্লাহমুখী হয়ে জীবনকে আরো সুন্দর করা। মুহাররমের এ মাসটিবিশেষ করে এর দশ তারিখ- ‘ইয়াওমে আশুরা’ এমনই একটি উপযুক্ত সময়।

মুহাররমের ফযীলতের একটি দিক হচ্ছেএর সাথে তাওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুক্তিনিরাপত্তা এবং গায়েবী সাহায্য লাভ করার ইতিহাস জুড়ে আছে। এজন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিতযাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরো বেশি ধাবিত হয়। বিশেষভাবে এ সময়ে তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হওয়া চাই।

এক সাহাবী নবীজীর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، أَيّ شَهْرٍ تَأْمُرُنِي أَنْ أَصُومَ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَان.

ইয়া রাসূলাল্লাহ! রমযানের পর আপনি কোন্ মাসে রোযা রাখতে বলেননবীজী বললেন-

إِنْ كُنْتَ صَائِمًا بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَصُمُ الْمُحَرّمَ، فَإِنّهُ شَهْرُ اللهِ، فِيهِ يَوْمٌ تَابَ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ، وَيَتُوبُ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ آخَرِينَ.

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.

তুমি যদি রমযানের পর রোযা রাখতে চাও তাহলে মুহাররমে রোযা রেখ। কেননা মুহাররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একদিন আছেযেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। -জামে তিরমিযীহাদীস ৭৪১

মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ দিনটি আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। দ্রষ্টব্য : লাতাইফুল মাআরেফপৃ. ৭৬

বান্দা তার নিজের ভাষায় রবের কাছে আকুতি পেশ করবেএটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহতিনি সেই আকুতি পেশ করার অর্থবহ শব্দ-বাক্যও বান্দাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহ্য় বর্ণিত সেই মাসনূন দুআগুলোর মর্ম ও ব্যঞ্জনা প্রতিটি মুমিনের হৃদয় ছুঁয়ে যায়যদি সে উপলব্ধির সাথে সেগুলো পাঠ করে। কুরআনে কারীমে আম্বিয়ায়ে কেরামের দুআ উল্লেখ করা হয়েছেযে ওসিলায় তাঁরা আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত প্রাপ্ত হয়েছেন। মুমিনের জন্য সেগুলো অনেক বড় সম্বল। হাদীসেও অনেক দুআ-ইস্তিগফার বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘সায়্যেদুল ইস্তিগফার’কে আমরা আমাদের ওজীফা বানাতে পারি। সায়্যেদুল ইস্তিগফার হচ্ছে-

اللّهُمّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلهَ إِلّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، فَإِنّهُ لاَ يَغْفِرُ الذّنُوبَ إِلّا أَنْتَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও আপনার প্রতিশ্রুতির উপর রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আমার প্রতি আপনার নিআমতের কথা স্বীকার করছি। আপনার কাছে আমি আমার গোনাহের কথা স্বীকার করছি। কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। -সহীহ বুখারীহাদীস ৬৩০৬

এছাড়া কুরআন-হাদীসে আরো অনেক তাৎপর্যমণ্ডিত দুআ-ইস্তিগফার উল্লেখিত হয়েছে। আমরা সেগুলোও ওজীফা হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। অন্তত মাঝে মাঝে হলেও উপলব্ধির সাথে সেগুলো পাঠ করা চাই।

দশ মুহাররম ‘ইয়াওমে আশুরা’ : গুরুত্ব ফযীলত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মুহাররম মাসের সবচে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফযীলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলী সমাজে এবং আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। 

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-

كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ، وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الكَعْبَةُ، فَلَمّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ، قَالَ رَسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَمَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ، وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ.

(জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হত। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনযে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৫৯২

এ হাদীসদ্বয় থেকে বুঝে আসে- জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ দিনে তারা কাবা শরীফে গেলাফ জড়াত। এ দিন তারা রোযা রাখত। নবীজীও এ দিন রোযা রাখতেন। হিজরতের পরও এ দিন রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা এখন মুস্তাহাব।

এরপর যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন দেখেনমদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোযা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদ্যাপন করছে। নবীজী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন-

مَا هَذَا الْيَوْمُ الّذِي تَصُومُونَهُ؟

এ দিনে তোমরা কী জন্য রোযা রাখছতারা বলল-

هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ.

এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হযরত মূসা আ. ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হযরত মূসা আ. এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।

নবীজী এ শুনে বললেন-

فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ.

হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজী নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বললেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৩০সহীহ বুখারীহাদীস ১১২৫৩৯৪৩

ইহুদীদের নিকট এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিলএ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদ্যাপন করত। হযরত আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত-

كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ، وَتَتّخِذُهُ عِيدًا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَصُومُوهُ أَنْتُمْ.

আশুরার দিন এমন একটি দিনযে দিনকে ইহুদীরা সম্মান করত এবং এ দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনতোমরা এ দিনে রোযা রাখ। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৩১

রোযা ও তাওবা : আশুরার বিশেষ আমল

আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে এ দিনের রোযা রাখা। পূর্ববর্তী হাদীসগুলোতে আমরা মাত্রই যা দেখে এলাম। এ দিনের রোযার ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.

আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখিতিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬২

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا اليَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ.

অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোযা রাখতে দেখিনি এবং রমযান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখতে দেখিনি। -সহীহ বুখারীহাদীস ২০০৬সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৩২

সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত  নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন-

যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে।

ঐ নারী সাহাবী বলেনএরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৯৬০সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৩৬

(সুবহানাল্লাহ! সাহাবায়ে কেরাম সন্তানদেরকে সেই শিশুকাল থেকেই কীভাবে তরবিয়ত করতে থাকতেন! আর মুমিন মায়েরা নিজেদের সন্তানদেরকে আমলে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার প্রতি কতটা সজাগ-সচেতন ছিলেন!!)

অতএব এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে আমরা খুব ইহতিমাম করব।

এছাড়া এর সাথে যেহেতু মিশে আছে আল্লাহর রহমত ও নাজাত লাভের ইহিহাসতাই এ দিনে কীভাবে আল্লাহর রহমত পেতে পারি এদিকে খুব খেয়াল রাখব। তেমনিভাবে যেহেতু গুনাহ মাফেরও ঘোষণা এসেছে এ দিনেতাই তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতিও খুব মনোযোগ দেব। আর একজন মুমিন তো রোযা অবস্থায় আল্লাহর রহমত লাভের অধিক প্রত্যাশী হয়।

যেভাবে রাখব আশুরার রোযা

এতক্ষণের আলোচনায় আশা করি এ বিষয়টি ফুটে উঠেছেআশুরার দিন রোযা রাখা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি আমল। এ দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। তবে এরচে উত্তম হলদশ মুহাররমের আগে বা পরে নয় বা এগার তারিখে একদিন অতিরিক্ত রোযা রাখা। নয় তারিখে রাখতে পারলে ভালো। কারণ হাদীসে নয় তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ إِنّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنّصَارَى؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা (খ্রিস্টানরা) সম্মান করেতখন নবীজী বললেন-

فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التّاسِعَ قَالَفَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৩৪

নয় তারিখ রোযা রখব’ মানে দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ মিলিয়ে রাখব। এজন্য ইবনে আব্বাস রা. বলতেন-

صُومُوا التّاسِعَ وَالعَاشِرَ وَخَالِفُوا اليَهُودَ.

তোমরা নয় তারিখ এবং দশ তারিখ রোযা রাখ এবং ইহুদীদের বিরোধিতা কর। -জামে তিরমিযীহাদীস ৭৫৫

(একটু চিন্তা করুন তোইসলামী শরীয়তে বৈধ এবং কাম্য একটি ইবাদতের ক্ষেত্রে যদি এমন বিরোধিতার কথা আসে তাহলে ইহুদী-নাসারাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং বিজাতীয় কালচারের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করার বিধান কত কঠোর হতে পারে! )

আর সবচে উত্তম হয়দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে আগে-পরে আরো দুটি রোযা রাখা। নয়দশ ও এগার সর্বমোট তিনটি রোযা রাখা। কারণপুরো মুহাররম মাসব্যাপি রোযার কথা তো সহীহ হাদীসেই আছে। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারীইবনে হাজার রাহ. ৪/২৪৬)

মুহাররম ও আশুরা কেন্দ্রিক কিছু গর্হিত রেওয়াজ

যে আয়াতটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আল্লাহ তাআলা যে কথাটি বলেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …

তোমরা এ দিনগুলোতে নিজেদের উপর জুলুম করো না। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

বস্তুত সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হওয়া। এমনিতেই যে কোনো সময়ই তা নিষিদ্ধ। তথাপি এ দিনগুলোতে আল্লাহর নাফরমানী থেকে বাঁচতে বিশেষভাবে হুকুম করা হচ্ছে। কারণ নেক ও কল্যাণের এমন মোক্ষম মুহূর্তে যে আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয় তারচে হতভাগা আর কে হতে পারে!

আফসোসের বিষয় হচ্ছেনেকীর এ সময়কে ঘিরে সমাজে রয়েছে বিভিন্ন গলত রসম রেওয়াজ এবং নানা রকমের বিদআতী কর্মকাণ্ড। এ সময়ের আমল ততটুকুযতটুকু উপরে হাদীসের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করা হল। মুহাররম  মাসকে কেন্দ্র করে এছাড়া আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। নেই এ দিনের জন্য বিশেষ নামাযবিশেষ যিকিরবিশেষ আয়োজন এবং বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা।

বিশেষ করে দশ মুহাররমে ‘হায় হোসেনহায় হোসেন’ মাতমের যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির অবতারণা করা হয় তা তো খুবই গর্হিত একটি সংস্কৃতি। ইসলামের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম মাতম ও শোক প্রকাশের এমন আয়োজনকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। এরচে জঘন্য হলএ দিনে ‘তাযিয়া’র নামে শিরক-বিদআতের আয়োজন করা। পরিতাপের বিষয়শিয়াদের এমন আয়োজনগুলোতে ঢালাওভাবে অনেক মুসলমান অংশগ্রহণ করে থাকে। এটা যে ঈমানের জন্য কত বড় হুমকি ও খতরা- তা কি তারা একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখেন!

কাজেই মুহাররম কেন্দ্রিক সকল গর্হিত কর্মকা- থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি সকল বিদআত-খুরাফাত ও রসম-রেওয়াজ থেকেও দূরে থাকা আবশ্যক। দেখা যায়ফযীলতের সময়গুলোতে সওয়াব হাছিল করতে গিয়ে উল্টো হারামে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ হতে থাকে। এটা তো কখনোই কাম্য নয়। আবার বিধানগতভাবে ফযীলতের এ ব্যাপারগুলো নফল হওয়ায় এ থেকে গাফেল থাকাও উচিত নয়। শরীয়ত যে বিধানকে যে স্তরে রেখেছে এবং যে সময়ের যতটুকু মূল্যায়ন করেছে ততটুকু করতে পারাই লাভ। এর কমবেশি করতে গেলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। তাই একদিকে যেভাবে সকল খুরাফাত ও রসম-রেওয়াজ পরিত্যাজ্যঅপরদিকে ফযীলতপূর্ণ এ আমল ও উপলক্ষগুলো নফল হওয়ায় এগুলোর ব্যাপারে বিলকুল গাফেল থাকাও সচেতন মুমিনের শান নয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

বান্দার উপর আমি যে বিধান ফরয করেছি আমার নৈকট্য লাভের জন্য তারচে’ উত্তম কিছু নেই। আর বান্দা (ফরয ইবাদতের পর) নফল আমলের মাধ্যমে আমার নৈকট্যের পথে অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায়ে সে আমার ভালবাসা লাভ করে। -সহীহ বুখারীহাদীস ৬৫০২

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ফরয বিধানের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকার পাশাপাশি নফল বিধানাবলির ক্ষেত্রেও মনোযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন।

বিশেষভাবে নতুন বছরে নতুন প্রত্যয় ও  পূর্ণ উদ্যমে ঈমান-আমলের পথে এগিয়ে যাবার তাওফীক দান করুন। আমাদের ঈমান-আমলকর্ম-আচরণস্বভাব-চরিত্রসহ জীবনের সকল অঙ্গনে উৎকর্ষ আসুক- এই পণ নিয়ে শুরু হোক আমাদের আগামীর পথচলা। আল্লাহ তাআলা সকলকে সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button