মুসলিম জাহানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত- হজ¦ ও কুরবানী সমাপ্ত হয়েছে। এই দুই ইবাদতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মাঝে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছিল। আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহমুখিতার পবিত্র অনুপ্রেরণা কিছুটা হলেও আমাদের দোলা দিয়েছিল। চিন্তা করলে দেখা যাবে, একমাত্র আল্লাহর স্মরণই আমাদের জীবন ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
আমাদের চারপাশে কষ্টের ব্যাপারগুলো বাড়ছে। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং, ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এগুলো আমাদের কর্মেরই ফসল।
কুরআন-সুন্নাহ্য় মানুষের ব্যক্তি-জীবন ও সামাজিক জীবনের ব্যাধিগুলো খুব পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই ভয়াবহ ব্যাধিগুলোর একটি হচ্ছে দুনিয়ার মোহ। দুনিয়ার মোহগ্রস্ত মানুষ অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে এমনই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, কিছুতেই তার পেট ভরে না। এর সাথে যখন আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন কোনো ব্যবস্থাই ব্যক্তি ও সমাজকে সহজ-স্বভাবিক অবস্থায় ধরে রাখতে পারে না।
আমাদের চারপাশে- দেশে ও দেশের বাইরে এর দৃষ্টান্তগুলো এখন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে আলোচনায় আসছে অর্থাৎ বিদ্যুতের লোডশেডিং, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনীতিতে ধসের আশঙ্কা ইত্যাদির পেছনের কারণ কী? নিঃসন্দেহে তা হচ্ছে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। কার্যকারণের এই দুনিয়ায় সবকিছুরই সুফল বা কুফল আছে। একটা পর্যায়ে তা প্রকাশ পায়।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِی الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ اَیْدِی النَّاسِ لِیُذِیْقَهُمْ بَعْضَ الَّذِیْ عَمِلُوْا لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ.
মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলভাগে ও জলভাগে নানা প্রকারের বালা-মুসীবত ছড়িয়ে পড়েছে। যেন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কর্মের স্বাদ আস্বাদন করান যাতে তারা ফিরে আসে। -সূরা রূম (৩০) : ৪১
সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে দুর্নীতি, অনাচার ও অপচয় যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা বড় ধরনের কোনো বিপদেরই পূর্বাভাষ। আল্লাহ তাআলা এই দেশ ও জাতিকে হেফাযত করুন এবং সকলকে তাঁর দিকে রুজু করার তাওফীক দান করুন। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই এ জাতিকে রক্ষা করতে পারেন এবং একমাত্র আল্লাহর ভয়ই পারে এ জাতিকে দুর্নীতি ও অনাচার থেকে মুক্ত করতে। দুর্নীতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, ছোট-বড় যে কোনো প্রকল্পে এখন বিষয়টি আলোচনায় আসছে; এমনকি করোনার টিকা-ক্রয় ও টিকা-দান কর্মসূচি নিয়েও বিভিন্ন সংস্থার যে রিপোর্ট পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা রীতিমত ভয়াবহ।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণত মূল্যস্ফীতির প্রচলিত নিয়মে প্রকাশ করা হয়। শহরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ৪২২ টি পণ্য বিবেচনায় নিয়ে থাকে। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী তার মধ্যে ২২৪ পণ্যের দাম ৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই গড় হিসাবটা দরিদ্র মানুষের কষ্টের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি উচ্চবিত্তের জন্য কোনো বিষয় না। কিন্তু নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য অনেক বড় বিষয়। দেশের বিরাট একটি অংশ অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে আছে। বিষয়টি খুব গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।
দরিদ্র মানুষের কষ্টের এই চিত্রের অপর পিঠে আছে বিত্তবানদের অপচয়ের নানা দৃষ্টান্ত। রাজধানীর একটি হোটেলে সোনার প্রলেপ দেয়া একেকটি আইসক্রিম লাখ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দেয়া হলে মাত্র এক দিনের মধ্যে তাদের প্যাকেজটি ওভারবুকড্ হয়ে যায় এবং সে কারণে এর অর্ডার নেয়া বন্ধ করতে হয়। তাহলে এদেশে এক-দুই মিনিটে লাখ টাকা চুষে খাওয়ার মতো লোকের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান এবং এ বিষয়ে তাদের আগ্রহেরও কোনো কমতি নেই। এরকম অপচয়-অপব্যয়ের নজির অসংখ্য। ভবিষ্যতের ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচতে হলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয় পর্যায়ে অপব্যয় থেকে বাঁচতে হবে।
দুর্নীতি, অপচয় ও অন্য সব অন্যায়-অনাচার থেকে বাঁচতে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতির কোনো বিকল্প নেই। পরিস্থিতির বিশ্লেষকরাও সবশেষে মূল্যবোধের কথাই বলছেন। মূল্যবোধের উন্নয়নই প্রকৃত উন্নয়ন। ক্ষীণ স্বরে হলেও আমাদের লেখক-প্রাবন্ধিকরা এ সত্য উচ্চারণ করতে আরম্ভ করেছেন। এদেশের আলেম-উলামা একথাটিই বলে আসছেন অনেক আগে থেকে। তাদের চিন্তা ও কর্মের মূল বিষয়ও এটি। সর্বস্তরে ঈমানী চেতনা বিস্তারের লক্ষ্যে তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। তাদের এই চেষ্টার মূল্যায়ন করা দরকার। আখেরাতের মুক্তি এই চেষ্টার মূল লক্ষ্যবস্তু হলেও ইহকালীন শান্তির চাবিকাঠিও এটিই।
আশার কথা হচ্ছে, এদেশের মানুষ সাধারণত ধর্মপরায়ণ। তাদের এই ধার্মিকতার সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমেই ঐসব ভয়াবহ ব্যাধির নিরাময় সম্ভব, যা একটি সম্ভাবনাময় জাতিকেও ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন ও তাওফীক দান করুন- আমীন।