হজ্ব ও উমরাহ

হজ্ব পরবর্তী জীবন কেমন হওয়া উচিত

মাওলানা আব্দুল্লাহ ফাহাদ

হজ্ব ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের মূল ভিত্তি, তার পঞ্চমটি হল হজ্ব। তবে নামায, রোযা থেকে হজ্বের বিধানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, এটি মুসলমানের উপর প্রতিদিন অথবা প্রতি বছর ফরয হয় না; বরং জীবনে মাত্র এক বারই ফরয হয়ে থাকে। আর বস্ত্তত হজ্ব পালন আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। হজ্বের পুরো ব্যাপারটিই মূলত আল্লাহর এক অনুগত বান্দা নবী হযরত ইবরাহীম আ.-এর স্মৃতিচারণ। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন পূর্ণ সফলতার সঙ্গে। পবিত্র কুরআন মজীদে যার বর্ণনা এসেছে। আল্লাহর প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মহা ত্যাগ আল্লাহর দরবারে এতই কবুল হয়েছিল যে, পরবর্তী নবীর উম্মতের জন্যও সে পাগলপারা বান্দার রূপ ও বেশ-ভূষা ধারণ করা  ইবাদতের অংশ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ ভালোবাসার টানে, যিয়ারতে বাইতুল্লাহর ঈমানী আকর্ষণে ছুটে আসে হজ্ব পালনে। ইযার পরনে গায়ে চাদর জড়িয়ে ফকীরের বেশে লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক… ধ্বনিতে মুখরিত থাকে সবখানে। যাদের অন্তর পবিত্র, যাদের অর্ন্তদৃষ্টি আছে, তারা দেখেন আল্লাহর কুদরত, তাঁর অপার মহিমা, তাদের মনে জাগে বার বার হাযিরীর সাধ। আর যাদের তা নেই, যাদের হৃদয় কলুষিত, তাদেরও হয় অনুভূতি, তারাও পায় অভাবিত স্বাদ। এ সময়ে যেন বয়ে বেড়ায় খোদার করুণার ফল্গুধারা, যার  পরশে সৌভাগ্যবানরা হয়ে ওঠেন আত্মহারা।

কিন্তু এই সৌভাগ্য তো তাদেরই নসীব  হয়, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন, যাদেরকে  তিনি দিয়েছেন তাঁর ঘর যিয়ারত করার সামর্থ্য। নামায-রোযার মতো এই ইবাদতটি সাধারণ মুসলমানের উপর আবশ্যকীয় নয়। এর জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু শর্তাবলি। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- ‘মানুষের জন্য আল্লাহর (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্ব করা অপরিহার্য, যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে।’ -সূরা আল ইমরান ৯৭

এই আয়াতের আলোকে ফকীহগণ বলেছেন যে, কোনো বালেগ মুসলমান দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হলেই তার উপর হজ্ব ফরয হবে না; বরং হজ্ব ফরয হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে সামর্থ্য। অর্থাৎ নিজ দেশ বা অঞ্চল থেকে মক্কা-মদীনায় যাওয়া-আসার খরচ, সেখানে অবস্থানকালীন খরচ এমনকি এ পূর্ণ সফরে নিজের পরিবার-পরিজনের খরচ বহন করার সামর্থ্য থাকা। আর যে ব্যক্তি উক্ত শর্তে উন্নীত হয় তার জীবনে কেবল এক বার হজ্ব করা ফরয। আর মূলত এই একটি বারের হজ্বই একজন মুসলমানের সতর্ক হওয়া, জীবনের ভুলগুলো শুধরিয়ে নতুন পথে চলা ও জীবনে আমূল পরিবর্তন আনার পক্ষে যথেষ্ট। কেননা হজ্ব মানুষের অন্তরে দুনিয়ার সবকিছুকে ভুলিয়ে একমাত্র মহান রাববুল আলামীনের ভালোবাসাকে বদ্ধমূল করে দেয়। আর তাই হজ্বের সময় মানুষ স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন ছেড়ে খোদার ভালোবাসায় ডুবে থাকে। মহা শক্তিধর, পরাক্রমশালী রবের দরবারে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ঐশী করুণায় হৃদয়-মন সিক্ত করে। বান্দা আর রবের সেই সময়কার অবস্থা  বলে বোঝানোর নয়। এটা শুধু স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে অনুভব ও অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়। হজ্বের লক্ষণীয় যে, নামায, রোযা ইত্যাদি ইবাদতের ফায়দা কুরআন মজীদে স্পষ্ট করেই বর্ণনা করা হয়েছে। নামাযের ফায়দা হল, নামায মানুষকে সকল অশ্লীল ও খারাপ কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখে। আর রোযা মানুষের মধ্যে তাকওয়া-খোদাভীতি সৃষ্টি করে, মানুষের হৃদয়ে এই অনুভূতি জাগ্রত করে যে, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ আমাকে দেখছেন। তেমনিভাবে যাকাতের ফায়দা হল, যাকাত মানুষের সম্পদকে পবিত্র রাখে। এর মাধ্যমে ধন-সম্পদে বরকত হয় ও গরীব-অসহায়দের প্রয়োজন মিটে।

কিন্তু হজ্বের ফায়দা বর্ণনা করতে গিয়ে শুধু বলা হয়েছে- অর্থ : ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থানসমূহে উপস্থিত হয়।’’ -সূরা হজ্ব ২৮

এখানে নামায-রোযার মতো হজ্বের কোনো নির্দিষ্ট ফায়দা উল্লেখ করা হয়নি; বরং শুধুমাত্র সশরীরে সেখানে উপস্থিত হয়ে তা সরাসরি উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, হজ্বের ফায়দা কাউকে বলে বোঝানোর মতো নয়। কারো থেকে শুনেও তা বোঝা যাবে না। এটি শুধু অনুভূতি দিয়ে বোঝার বিষয়। এজন্যই মানুষ এ সময়ে তার আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। তার চিন্তা-ধারা, কার্যকলাপে সে পরিবর্তন লক্ষ করে। আর এর প্রতিফলন ঘটে তার বাস্তব জীবনে। এমনকি তার আগ্রহ-উদ্দীপনার ধারা পরিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হয়ে ওঠে। আর সে নিজেও অনুধাবন করতে পারে যে, এখন সে আর আগেকার সেই মানুষটি নেই, এখন সে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ হয়ে গেছে।

এখানে একটি কথা জেনে নেওয়া উচিত যে, হজ্বের এত ব্যাপক ফায়দা থাকলেও প্রত্যেকে শুধু নিজের অবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তা অনুভব করতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে ইখলাস, তাকওয়া ও মুজাহাদা যত বেশি হবে, যে যত সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে হজ্বের কাজগুলো আঞ্জাম দিবে সে তত বেশি ফায়দা অনুভব করবে। হজ্ব তাকে ততটাই প্রভাবিত করবে। একাধিকবার হজ্ব করলেও প্রতিবারই নতুন নতুন ফায়দা তার অনুভূত হতে থাকবে। প্রতিবারই সে নতুনভাবে প্রভাবিত হবে। ঈমানে ও বিশ্বাসে আগের চেয়ে অধিক সতেজ হয়ে উঠবে।

আর যেহেতু এসময় মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ভুলে এক মাওলার ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পিত করে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাঁর করুণা, মহিমা সরাসরি উপভোগ করতে থাকে, তাছাড়া পবিত্র ভূমিতে, পূণ্যময় স্থানসমূহে নিজেকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে মুক্ত রাখে, শয়তানের ধোঁকা ও গুনাহর যাবতীয় উপকরণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে নিজের অতীত গুনাহর ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে তাই হজ্বই মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে যথেষ্ট। এ অল্প সময়ের মুজাহাদা তাকে বাকি জীবন গুনাহমুক্তভাবে বাঁচতে উৎসাহিত করে। ফলে আল্লাহর ভালোবাসায় উজ্জীবিত এ মানুষটির পক্ষে হজ্বপরবর্তী জীবনে যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা অতি সহজ হয়।

হজ্বের একটি ফযীলত হল, হজ্বের মাধ্যমে মানুষ অতীত জীবনের যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করে। তবে বান্দার হক ব্যতীত।  হাদীস শরীফে এসেছে-

অর্থ : ‘যে ব্যক্তির আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করে এবং সকল অশ্লীল ও গুনাহর কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাদ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ (সহীহ বুখারী ১:২০৬)

অর্থাৎ হজ্ব মানুষের জীবনের সকল গুনাহ মুছে দেয়। তবে বান্দার কোনো হক অনাদায়ী থাকলে তা ব্যতীত। এজন্যই হজ্বে যাওয়ার আগে হজ্বের  প্রধান প্রস্ত্ততি হচ্ছে মুরববীদের কাছ থেকে দুআ নেওয়া ও কারো হক অনাদায়ী থাকলে তা পরিশোধ করে দেওয়া। আর পরিশোধ করা সম্ভব না হলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।

আর তাই কেউ যদি বান্দার যাবতীয় অনাদায়ী হক আদায় করে হজ্বের সফরে বের হয় এবং সকল বিধি-নিষেধ মেনে হজ্ব আদায়ে সক্ষম হয় তাহলে সে সদ্যভূমিষ্ট শিশুর মতোই নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর এ নিষ্পাপ বান্দাটির সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক আরো গভীর হয়। সুতরাং হজ্বের পর দেশে ফিরেও যেন সে গুনাহ ও পঙ্কিলতামুক্ত থাকে, তার বাকিটা জীবন যেন নিষ্পাপ শিশুর মতোই কেটে যায় এজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি। আর এটিই হবে আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার মূল দাবি ও একজন সাচ্চা আশেকের সতেজ ইশকের বহিঃপ্রকাশ।

দেশে ফিরে করণীয়

হজ্বের সফরের পূর্ণ সময়টা মূলত মানুষের জীবনে তাকওয়া ও খোদাভীতি অর্জনের এক মোক্ষম সময়। এ স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে একজন মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তোলে। তাই দেশে ফিরেও যেন সেই তাকওয়া অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক। আর হজ্বের সফরের আগে থেকে পেশাগত অথবা অন্য কোনো কারণে কোনো প্রকার গুনাহর কাজে জড়িত থাকলে  হজ্ব সফরের পূর্বেই তা থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক হয়ে যাওয়া এবং হজ্বের সময় জুড়ে আল্লাহর কাছে বারংবার কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা জরুরি। আর হজ্ব শেষে দেশে ফিরে সব রকমের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।

এজন্য আল্লাহ ওয়ালাদের সংস্পর্শে থাকা উচিত। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- অর্থ ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাক।’ (সূরা তাওবা : ১১৯)

এ আয়াতে প্রথমত মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর এই ভয় করার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর অবাধ্যতা না করা ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।

তবে যেহেতু আমাদের পরিবেশে গুনাহ থেকে বাঁচা খুবই কঠিন, কেননা, আমাদের চারদিকে শুধু গুনাহ আর গুনাহ। তাই এ পরিবেশে তাকওয়া অবলম্বনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত ও সাহচর্যে থাকা। কারণ আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দেওয়ার পাশাপাশি আল্লাহ ওয়ালাদের সাহচর্যে থাকারও নির্দেশ করেছেন। আর কুরআনের একটি নীতি এই যে, যখনই আল্লাহ তাআলা এমন কোনো হুকুম প্রদান করেন, যা পালন করা কষ্টসাধ্য তখন পাশাপাশি অন্য এমন একটি আদেশ প্রদান করে থাকেন যার উপর আমল করলে প্রথম হুকুমের উপর আমল করা সহজ হয়ে যায়। আর তাই আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে থাকা, তাদের সাথে সম্পর্ক গড়া, তাদের কথা মান্য করা ইত্যাদির মাধ্যমে গুনাহ থেকে সহজেই বেঁচে থাকা সম্ভব। কেননা, মানুষ স্বভাবগতভাবেই পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলে গুনাহর পরিবেশ বর্জন করে নেক ও সৎ লোকদের পরিবেশে নিজেকে অভ্যস্ত করে বাকি জীবন গুনাহমুক্তভাবে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা অপরিহার্য।

এছাড়া নিম্নোক্ত আমলগুলো নিয়মিতভাবে করে যাওয়া উচিত।

১। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কিছু পরিমাণ কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করা।
২। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে তাকবীরে উলার সাথে আদায়ের চেষ্টা করা।
৩। প্রতিদিনের ফরয ও সুন্নত নামাযের পাশাপাশি কিছু পরিমাণ নফল নামাযেরও অভ্যাস গড়ে তোলা।
৪। প্রত্যহ তাহাজ্জুদ নামায পড়তে চেষ্টা করা।
৫। প্রতিদিন ইস্তেগফার, দুরূদ শরীফ ও অন্যান্য দুআ-যিকির ইত্যাদি পাঠ করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দিন। আমীন।

[হযরত মুফতী রফী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম এর একটি আলোচনা অবলম্বনে লিখিত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button