কুরবানিহজ্ব ও উমরাহ

হজ্ব ও কুরবানী

আলোকিত সময়ের আলোকিত শিক্ষা

এখন আমরা হজ্বের পবিত্র মাসগুলো অতিক্রম করছি। কুরআন মাজীদের ইরশাদ (তরজমা) হজ্ব হয় সুবিদিত সময়সমূহে। (সূরা বাকারা ২ : ১৯৭) অর্থাৎ শাওয়াল যিলক্বদ ও যিলহজ্বে। এ মাসগুলোতেই হজ্বের ইহরাম ধারণ করা হয় আর যিলহজ্বের নির্ধারিত তারিখে নির্ধারিত আমল সম্পন্ন করার দ্বারা হজ্ব সমাপ্ত হয়।

হজ্ব ছাড়াও যিলহজ্বে আছে সাধারণ কুরবানী, যা গোটা পৃথিবীর সামর্থ্যবান মুসলিম নারী-পুরুষ নিজ নিজ ভূখন্ডে আদায় করেন।

হজ্ব ও কুরবানীর পবিত্র মওসুম কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে আসে। এটি আমাদের আত্মপরিচয় নতুন করে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়।

আমাদের পরিচয়-আমরা মুমিন, মুসলিম। তাওহীদ, রিাসালাত, আখিরাতসহ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত সকল আকীদা-আহকামে আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এক আল্লাহর আদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত। আর ঈমান ও ইসলামের এ মহাসূত্রে গোটা বিশ্বের সকল মুসলিম আমরা এক পরিবার। হজ্ব ও কুরবানীর মওসুম এ মহাসত্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

হজ্বের সূচনা হয় নিয়ত ও তালবিয়ার দ্বারা। এরপর বার বার উচ্চারণ করা হয় এ পবিত্র বাক্যমালা, যাতে আছে তাওহীদের ঘোষণা, আল্লাহর বিধানের সামনে সমর্পণ ও আনুগত্যের ঘোষণা, সৃষ্টি জগতে একমাত্র তাঁরই ফয়সালা কার্যকর-এ বিশ্বাসের ঘোষণা আর সকল প্রকারের শিরক ও শরীক থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা। এককথায়, এ হচ্ছে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ও অঙ্গিকারের নবায়ন, যা রক্ষা করতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত  জীবনের সকল কর্মে ও বিশ্বাসে।

হজ্বের এক বড় শিক্ষা ‘শাআইরুল্লাহ’র সম্মান। শাআইরুল্লাহ মানে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ স্থান ও বস্ত্ত। এগুলোর সম্মান তাকওয়া ও খোদাভীতির অংশ। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এ তো তার হৃদয়ের তাকওয়া-সঞ্জাত।’-সূরা হজ্ব ২২ : ৩২

কাবা-যামযাম, মিনা-আরাফা, সাফা-মারওয়া, হজরে আসওয়াদ, হাদী ও কুরবানীর প্রাণী ইত্যাদি যে মুমিনের কাছে সম্মানের তা এ কারণেই। সুতরাং আল্লাহর দ্বীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়াদির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং এগুলোর মর্যাদা রক্ষা হজের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। দ্বীনের প্রতি এবং দ্বীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত স্থান, বস্ত্ত ও ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হচ্ছে ঈমান রক্ষার অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। হাদীস শরীফে তো বৃদ্ধ মুসলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে বলা হয়েছে আল্লাহকে ভয় ও সম্মান করার অংশ। সুতরাং এ বিষয়ে সচেতন হওয়া অতি জরুরী। মনে রাখতে হবে, দ্বীনের বিষয়ে শ্রদ্ধার অভাবই বেদ্বীন হওয়ার প্রথম ধাপ।

ইসলামী ভ্রাতৃত্ব রক্ষা এবং একে অপরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকাও হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ, কটুবাক্য ব্যবহার, উত্তেজিত হওয়া ও উত্তেজিত করা হজ্বের সফরে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি হজ্বের বিভিন্ন আমলেও অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচার বিধান আছে। যেমন ভীড়ের কারণে অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া হজরে আসওয়াদে চুম্বন করা সম্ভব না হলে দূর থেকেই হাত তোলার নিয়ম আছে আর এ শুধু হজ্বের সফরের বিধান নয়, গোটা জীবনের বিধান। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিদায় হজ্বের বাণী, (অর্থ) সাবধান! তোমাদের একের রক্ত, সম্পদ, ইজ্জত-আব্রু অন্যের জন্য তেমনি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত যেমন এ শহরে এ মাসে আজকের এই দিন নিষিদ্ধ ও সম্মানিত। তাঁর সেই পবিত্র ভাষণের কথাগুলো আজ আবার আমাদের স্মরণ করা উচিত।

ঐ ভাষণেই তিনি উম্মতকে পুনঃসাবধান করেছেন শিরক সম্পর্কে, বিশেষভাবে স্মরণ করিয়েছেন খতমে নবুওতের কথা, স্মরণ করিয়েছেন সালাত-যাকাত, সওম ও হজ্বের কথা। বিশেষভাবে তাকীদ করেছেন দ্বীনী ইলমের বিষয়ে।

ঐ ভাষণে তিনি নারীর বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করতে বলেছেন। স্মরণ করিয়েছেন স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের হক।

ঐ ভাষণে তিনি বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন সকল জাহেলী রসম-রেওয়াজের, গোত্র-বর্ণ, ভাষা ও ভূখন্ডের পরিবর্তে তাকওয়া ও খোদাভীতিকেই ঘোষণা করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড।

ঐ পবিত্র ভাষণে তিনি রিবা ও সুদের নিষিদ্ধতা এবং কারো সম্পদ তার আন্তরিক সন্তুষ্টি ছাড়া গ্রহণের অবৈধতা পুনরায় ঘোষণা করেছেন। তাঁর সেই ভাষণের কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করা উচিত।হজ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অশ্লীলতা বর্জন। হজ্বের সফরে বিশেষভাবে যে কাজগুলো করা নিষিদ্ধ তা হচ্ছে অশ্লীল কথা বলা, গুনাহ করা এবং পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া। (সূরা বাকারা ২ : ১৯৭) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিশেষ বাক্যালাপও যখন হজ্বের সফরে অবৈধ তখন অন্য প্রসঙ্গের কথা তো বলাই বাহুল্য। বিদায় হজ্বের আগে আল্লাহর রাসূল মক্কায় ঘোষণা করেছিলেন। এ বছর থেকে কোনো মুশরিক যেন হজ্ব করতে না আসে আর কোনো বিবস্ত্র ব্যক্তি যেন বাইতুল্লাহর তাওয়াফ না করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সাথে ইসলামের কোনো আপস নেই।

মক্কায় পবিত্র-ভূমি, যমযম, সাফা-মারওয়ার সাথে জড়িয়ে আছে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের কত আলোকিত ইতিহাস। আল্লাহর আদেশে আল্লাহর খলীলের স্ত্রী ও পুত্রকে তৃণলতাহীন বিরাণ ভূমিতে রেখে যাওয়া, শিশু-সন্তান কোলে এক মমতাময়ী মায়ের পবর্তপ্রমাণ তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ-ভরসা। সঙ্কটের মূহুর্তে সাফা-মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি আর আল্লাহর নুসরতের ধারা-যমযম। এরপর কুরবানীর অগ্নি-পরীক্ষায় পিতা-পুত্রের উত্তীর্ণ হওয়া, আল্লাহর ঘর নির্মাণ, আখেরী নবীর আগমনের জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত এরপর আখেরী নবীর আগমন, তাঁর দাওয়াতে তাওহীদ ও ঈমান, মুশরিক-পৌত্তলিকদের চরম বিরোধিতায় মুমিন-মুসলিমগণের কারাবরণ ও শাহাদতবরণ এরপর হিজরত ও স্বদেশ ত্যাগ সবশেষে আল্লাহর নুসরতে বিজয়ীর বেশে আল্লাহর নবীর এ ভূখন্ডে প্রবেশ। এককথায়, আল্লাহর বান্দাদের চরম ত্যাগ ও কুরবানী আর আল্লাহর তরফ থেকে চূড়ান্ত মদদ ও নুসরতের একেকটি উজ্জ্বল অধ্যায় তো এখানেই, এই ভূখন্ডতেই রচিত হয়েছে। অতএব এখান থেকে আমরাও তো গ্রহণ করতে পারি চেতনা ও সাহসের কিছু আলো।

আজ উম্মাহর চরম দুর্দিনে সেই পরম ইতিহাসই আমাদের আলোকবর্তিকা, আমাদের চালিকা শক্তি।

সুতরাং এই পবিত্র ভূমিতে বিচরণের তাওফীক আল্লাহ যাদের দেবেন কিংবা হজ্ব ও কুরবানীর এ আলোকিত মওসুম যাদের অতিক্রম করার সুযোগ হবে তারা তো সত্যিই ভাগ্যবান। আমরা যদি সচেতন হই, যদি হৃদয়ের দ্বার খুলি তাহলে এই পবিত্র সময়ে আমাদের জন্য আছে শিক্ষা ও চেতনার অনেক কিছু, সাহস ও সান্ত্বনার অনেক উপকরণ ।

মেহেরবান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হজ্ব ও কুরবানীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব শিক্ষা উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button