ইসলামনামাজ

জানাজার নামাজের নিয়ম ও দোয়া সমূহ

রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের জানাজায় শরীক হয়ে নামাজ পড়ে এবং তাকে কবরও দেয় সে দুই কীরাত নেকী পায়।”

মায়াময় এই পৃথিবীর কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা ধ্বংসশীল এই পৃথিবীতে মৃত্যুকে করেছেন প্রতিটি প্রাণের চূড়ান্ত পরিণতি। তিনি এরশাদ করেন, ‘প্রতিটি প্রাণকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ মৃত্যুর মাধ্যমে রুহকে তিনি বিদায় দেন দেহ থেকে, পৃথিবীর সকল বস্তুসম্ভার থেকে অনন্ত জগতের পথ-প্রান্তরে।
আমাদের জীবদ্দশাতেই আমাদের চোখের সামন দিয়ে আমাদের প্রিয়জনরা কবরস্থ হন। চলে যান আপনজন, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ অনেক আত্মীয়। এমনকি বাবা-মা, নিজ সন্তান বা সহোদর ভাই-বোনের মৃত্যুও কখনো আমাদের দেখতে হয়। আমরা এ অনিবার্য বাস্তবতার আঘাতে চূড়ান্ত ব্যথাতুর শোক-স্তব্ধ বিহ্বল হয়ে যাই। কিন্তু সেই ক্ষণটা আরও খুব আফসোসের হয় যখন তাদের বিদায় দেবার সময় শেষ জানাজার নামাজটুকুও না জানার কারণে পড়তে পারি না। জানা থাকে না পদ্ধতি, কারো জানা থাকে না সহজ দোয়াটিও।


জানাজার নামাজের ফযিলত


রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের জানাজায় শরীক হয়ে নামাজ পড়ে এবং তাকে কবরও দেয় সে দুই কীরাত নেকী পায়। প্রত্যেক কীরাত উহুদ পাহাড় সমান নেকী। আর যে ব্যক্তি শুধু জানাজার নামাজ পড়ে এবং মাটি দেয় না সে এক কীরাত নেকী পাবে।’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জানাজায় এমন চল্লিশজন লোক যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করেননি, যদি শরীক হয়ে ঐ লাশের জন্য দোয়া করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সুপারিশ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।’ (সহীহ মুসলিম ও মিশকাত)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- 

‘যখন কোনো মুসলমানের ইন্তেকাল হয় এবং একশ জনের কাছাকছি সংখ্যক মুসলমান তার জানাজার নামাজ পড়ে ও তার জন্য সুপারিশ করে তো এই সুপারিশ কবুল করা হয়’।
(জামে তিরমীযি)

উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানাজার নামাজে শরীক হওয়াতে নিজের ও মৃত ব্যক্তির লাভের কথা জানলাম। নিম্নে জানাজার নামাজের নিয়ম ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করা হল।


জানাজা নামাজের নিয়ম


১. প্রথম তাকবীরের পর ছানা পড়া।
২. দ্বিতীয় তাকবীরের পর দরূদ পড়া।
৩. তৃতীয় তাকবীরের পর দুআ পড়া।
৪. চতুর্থ তাকবীরের পর সালাম ফিরানো।

হাত উঠানো : জানাজা নামাজে শুধু প্রথম তাকবীরে হাত উঠাবে এছাড়া আর কোনো তাকবীরে হাত ওঠানোর বিধান নেই।


জামাআত যেভাবে দাঁড়াবে


জামাআতের সামনে কাফন ঢাকা লাশ রাখতে হবে। তার পেছনে লাশের সিনা বরাবর ইমাম দাঁড়াবেন। তার পেছনে মুক্তাদীরা কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবেন। সবাই মনে মনে ইচ্ছা করবেন : এই মৃত ব্যক্তির দোয়ার জন্য জানাজার নামাজ পড়ছি। মূলত এটাই হল নিয়ত।


জানাজা নামাজের নিয়ত ও দোয়া সমূহ


শুদ্ধ আরবি জানা না থাকলে জানাজার নামাজ সহ যে কোনো নামাজের নিয়তই নিজের মাতৃভাষায় করাই উত্তম। অর্থ না জেনে অশুদ্ধ আরবিতে নিয়ত করার বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। কেননা নিয়ত তো হল অন্তরের ইচ্ছা ও সংকল্পের নাম। তবু আগ্রহীদের জন্য নিম্নে আরবি নিয়ত উল্লেখ করছি।

نَوَيْتُ اَنْ اُوَدِّيْ لِلّٰهِ تَعَالٰى اَرْبَعَ تَكْبِرَاتٍ صَلْوَةِ الْجَنَازَةِ فِرْضِ الْكِفَايْةِا لثَّنَاءُ لِلّٰهِ تَعَالٰى وَالصَّلَوةُ عَلٰى النَّبِي وَالدُّعَاءُ لِهَذَا الْمَيْتِ اِقْتَدَيْتُ بِهَذَاالاِمَامِ مُتَوَجِّهًا ا لٰى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفِةِ اَللهُ اَكْبَر.

বাংলা উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন উওয়াদ্দিয়া লিল্লাহি তা’আলা আরবা’আ তাকবীরাতিন সালাতিল জানাযাতি ফারদিল কেফাইয়তি আছ্ছানাউ লিল্লাহি ওয়াস সালাতু আলান্নাবীয়্যি ওয়াদ্দু’আউ লিহাযাল মাইয়্যিতি ইক্বতাদাইতু বিহাজাল ইমামি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি-আল্লাহু আকবার।

নিয়তের অর্থ : (সংক্ষেপে) আল্লাহর জন্য আমি কেবলামুখী হয়ে চার তাকবীরের সাথে এই ইমামের পেছনে জানাজার ফরজে কেফায়া নামাজ আদায় করছি, ‘আল্লাহু আকবার।’

নিয়ত করে ইমাম উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবার বলে অন্য নামাজের মত হাত বাঁধবে। এরপর ছানা পাঠ করবে। মুক্তাদীগণ ইমামের অনুসরণ করে একইভাবে তাকবীর দিয়ে ছানা পড়বে। এরপর ইমাম হাত উত্তোলন না করেই উচ্চস্বরে দ্বিতীয় তাকবির দিবে। এরপর নিম্নস্বরে অন্য নামাজের দরূদের ন্যায় দরূদ পড়বে। মুক্তাদীরাও ঐরূপ করবে। দরূদ শেষ করে ইমাম তৃতীয় তাকবীর দিয়ে হাত বাঁধা অবস্থাতেই মৃত ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হলে নিম্ন স্বরে এই দোয়া পড়বে-

اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِ نَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَنَا اَللّٰهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلٰى الْاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلٰى الْاِيْمَانِ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগ ফিরলি হায়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াহতাহু মিন্না, ফাআহয়িহী আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহ আলাল ইমান।

অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড় এবং পুরুষ ও নারী সকলকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাদেরকে জীবিত রেখেছেন ইসলামের উপর জীবিত রাখেন আর যাদেরকে মৃত্যু দান করেছেন তাদেরকে ঈমানের সঙ্গেই মৃত্যু দান করেন।’

আর জানাজা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কারো হলে উক্ত দোয়ার পরিবর্তে এই দোয়া পড়বে :

اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرَطًا وَّاجْعَلْهُ لَنَا اَجْرً ا وَّاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّمُشَفِّعًا

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাজ আলহু লানা ফারাতাও ওয়াজ আলহু লানা আজরাও ওয়াজ আলহু লানা শাফিআও ওয়া মুশাফফাআ।
অর্থ: হে আল্লাহ, আপনি তাকে আমাদের জন্য অগ্রবর্তী হিসেবে কবুল করুন, তাকে করুন আমাদের জন্য প্রতিদান স্বরূপ এবং তাকে বানান আমাদের জন্য সুপারিশকারী -যার সুপারিশ কবুল করা হবে।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাশ মেয়ের হলে ‘হু’ (هُ) স্থানে ‘হা’ (هَا) বলতে হবে। এই দুআ পাঠের পর ইমাম চতুর্থ তাকবীর বলে প্রথমে ডানে ও পরে বামে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি’ বলে সালাম ফিরাবে। মুক্তাদীরাও তার অনুকরণ করবে।


জানাজার জরুরি মাসায়েল


• মাসআলা : ছানা, দরূদ ও দুআর পরে যে আরো তিনবার তাকবীর বলতে হয় তখন ইমাম ও মোক্তাদীর হাত বাঁধা থাকবে।
• মাসআলা : ইমাম তাকবীর ব্যতীত সবকিছুই চুপে চুপে বলবে, শুধু তাকবীর উচ্চস্বরে বলবে। মোক্তাদীরা তাকবীরসহ সবকিছুই আস্তে আস্তে বলবে।
• মাসআলা : ডান দিকে সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত এবং বাম দিকে সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাম হাত নামিয়ে ফেলবে।
• মাসআলা : জানাজার নামাজের পরে আর কোনো দোয়া বা মোনাজাত এক সঙ্গে করার বিধান নেই।
• মাসআলা : জানাজার নামাজ ছুটে যাওয়ার আশংকা হলে (পানি নিকটে থাকা সত্ত্বেও) তায়াম্মুম করে জানাজায় শরীক হওয়া যায়।
• মাসআলা : জুতা পায়ে রেখেও জানাজার নামাজ পড়া যায়। তবে শর্ত এই যে জুতার তলা এবং জুতার নিচে জায়গা পাক থাকতে হবে। আর যদি জুতা খুলে জুতার উপরে পা রেখে দাঁড়ায় তাহলে পায়ের সঙ্গে লেগে থেকে জুতার উপরের অংশ পাক থাকলেই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button