ইতিকাফমাসয়ালা-মাসায়েলরামাদান

ইতিকাফের হুকুম – করনীয় ও বর্জনীয়

রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ

আভিধানিক অর্থে ইতিকাফ হচ্ছে কোনোকিছুতে এঁটে থাকা ও তার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা।

শরয়ী পরিভাষায় ইতিকাফ

আল্লাহ তাআলার ইবাদতের উদ্দেশে মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা

ইতিকাফের শরীয়তভুক্ত হওয়া

ইতিকাফ উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের মধ্যে একটি। আয়শা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে আমরণ ইতিকাফ করে গেছেন।’(বর্ণনায় বুখারী)

ইতিকাফ আমাদের জন্য ও আমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য আল্লাহ তাআলা বিধানভুক্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

(وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥ )

{এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর।’ আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ‘ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর।} [সূরা আল বাকারা:১২৫]

ইতিকাফের হুকুম

ইতিকাফ সারা বছরই সুন্নত তবে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করাই উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন সবসময় ইতিকাফ করে গেছেন।

ইতিকাফের শর্তসমূহ

১- নিয়ত

ইতিকাফকারী আল্লাহর ইবাদত ও সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে মসজিদে অবস্থানের নিয়ত করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় নিয়তের ওপর আমলের নির্ভরতা।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

২- যে মসজিদে ইতিকাফ করা হবে তা জামে মসজিদ হতে হবে

জামে মসজিদ অর্থ এমন মসজিদ যাতে জুমার নামাজ পড়া হয় এবং যাতে যেকোনো এলাকার মুসাল্লীদের নামাজ আদায়ের অধিকার উন্মুক্ত থাকে।

৩ – বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন

অতএব জুনুবী ব্যক্তি এবং হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত নারীর ক্ষেত্রে ইতিকাফ করা শুদ্ধ হবে না; কেননা এদের মসজিদে অবস্থান করা বৈধ নয়।

ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়

ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়; ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, ‘আমি জাহিলীযুগে মানত করেছিলাম যে একরাত মসজিদুল হারামে ইতিকাফ করব। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি তোমার মানত পুরা করো।’ সে হিসেবে যদি রোজা রাখা শর্ত হতো তাহলে রাতের বেলায় ইতিকাফ শুদ্ধ হত না। কেননা রাতের ইতিকাফে কোনো রোজা নেই। এ ক্ষেত্রে আরেকটি দলিল এই যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাওয়ালের প্রথম দশদিন ইতিকাফ করেছেন বলে এক বর্ণনায় এসেছে। আর এটা সবার জানা যে, শাওয়ালের প্রথম দশদিনের মধ্যে ঈদের দিন রয়েছে, যাতে রোজা রাখা বৈধ নয়। আরেকটি বিষয় এই যে, রোজা ও ইতিকাফ দুটি ভিন্ন ইবাদত। কাজেই একটির জন্য অন্যটি শর্ত হবে না।

ইতিকাফের সময়

যেকোনো দিন ইতিকাফ করা শুদ্ধ। যেকোনো সময়সীমার জন্যও ইতিকাফ করা শুদ্ধ। তবে উত্তম হলো একদিন একরাতের কম না হওয়া; কেননা একদিন একরাতের কম ইতিকাফ করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কারও থেকেই প্রমাণিত নেই।

রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা

এ দশদিন হলো ইতিকাফ করার সর্বোত্তম সময়; আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। আমরণ তিনি তা করে গেছেন।

যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশদিনে ইতিকাফের নিয়ত করবে সে রমজানের একুশ তারিখে, যে মসজিদে ইতিকাফ করতে চায়, সে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়বে। এরপর ইতিকাফের জায়গায় প্রবেশ করবে। আয়শা রাযি. ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানেই ইতিকাফ করতেন। তিনি যখন ফজরের নামাজ আদায় করতেন তখন ইতিকাফের স্থলে প্রবেশ করতেন।’ [বর্ণনায় বুখারী]

রমজানের শেষ দিনের সূর্যাস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ইতিকাফ শেষ হয়ে যায়, তবে উত্তম হলো ঈদের দিন সকালে ইতিকাফ থেকে বের হওয়া। সালাফদের অনেকেই এরূপ করেছেন।

ইতিকাফকারীর জন্য যা বৈধ

১ – একান্ত প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া, যেমন খাওয়া ও পান করার প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া যদি তা মসজিদে হাজির করার জন্য কেউ না থাকে। পেশাব পায়খানার প্রয়োজনেও মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে। আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইতিকাফ করতেন, তিনি তাঁর মাথা আমার দিকে হেলিয়ে দিতেন, অতঃপর আমি তা আঁচড়িয়ে দিতাম। আর তিনি মানবিক প্রয়োজন ব্যতীত বাড়িতে প্রবেশ করতেন না।’(বর্ণনায় মুসলিম)

২ – চুল ভাঁজ করা ও আঁচড়ানো বৈধ; উল্লেখিত হাদীস এর প্রমাণ ।

৩ – মানুষের সাথে উপকারী কথাবার্তা বলা। তারা কেমন আছে না আছে ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা। কিন্তু অতিমাত্রায় এসব কথাবার্তা বলা উচিত হবে না। কেননা তা ইতিকাফের উদ্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক।

৪ – আত্মীয়স্বজন ইতিকাফকারীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আসতে পারবে। এমনকি তাদেরকে বিদায় দেয়ার জন্য ইতিকাফের জায়গা থেকে বের হওয়াও বৈধ রয়েছে। সাফিইয়া বিনতে হুআই রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় আমি তাঁর সাথে রাতের বেলায় সাক্ষাৎ করতে এলাম। আমি তার সাথে কথা বললাম। এরপর যখন চলে যাওয়ার উদ্দেশে দাঁড়ালাম তিনি আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

ইতিকাফ বাতিলকারী-বিষয়সমূহ

১ – প্রয়োজন ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদ থেকে বের হওয়া, যদিও তা অল্প সময়ের জন্য হয়; আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিক প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হতেন না।’

(বর্ণনায় মুসলিম) উপরন্তু মসজিদ থেকে বের হওয়ার অর্থ ইতিকাফস্থলে অবস্থান করার যে নীতি রয়েছে তা ভঙ্গ হওয়া। আর ইতিকাফস্থলে অবস্থান করা ইতিকাফের একটি রুকন।

২ – স্বামী-স্ত্রীর মিলন, যদিও তা রাতের বেলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

( وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ)

{আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।}
[সূরা আল বাকারা:১৮৭]

স্বামী-স্ত্রীর মিলনের সাথে যুক্ত হবে উত্তেজনাসহ যেকোনো উপায়ে বীর্যপাত ঘটানো, যেমন হস্তমৈথুন অথবা স্ত্রীর অন্যকোনো শরীরাংশে ঘর্ষণের মাধ্যমে বীর্যপাত|

৩ – ইতিকাফ ভঙ্গ করার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করা।

যদি কোনো মুসলিম সুনির্দিষ্ট দিনের ইতিকাফের নিয়ত করে, এরপর ইতিকাফ ভঙ্গ করে ফেলে তবে তার জন্য ইতিকাফ কাযা করা বৈধ হবে। আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইতিকাফের নিয়ত করতেন, তিনি ফজরের নামাজ পড়তেন, অতঃপর তিনি ইতিকাফস্থলে প্রবেশ করতেন। (একবার) তিনি তাঁর তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন, অতঃপর তাঁবু টানানো হলো – অর্থাৎ যখন তিনি রমজানের শেষ দশদিনের ইতিকাফ করার ইচ্ছা করলেন তখন- যয়নাব রাযি. তাঁর তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন, অতঃপর টানানো হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীগণও তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন, অতঃপর টানানো হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ফজরের নামাজ পড়লেন, তিনি বহু তাঁবু দেখতে পেলেন। তিনি বললেন,‘তোমরা কি ভালো চাও? এরপর তিনি তাঁর তাঁবু গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন, অতঃপর তা গুটিয়ে ফেলা হলো। তিনি রমজানে ইতিকাফ করা ছেড়ে দিলেন এবং শাওয়ালের প্রথম দশদিন ইতিকাফ করলেন।’ অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী ‘শাওয়ালের শেষ দশদিন ইতিকাফ করলেন।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম )ইতিকাফকারী ব্যক্তি রোগী দেখতে যাবে না। জানাযায়ও শরীক হবে না, বরং সে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশে ইতিকাফস্থলে অবস্থান করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button